Bikroy আপডেট

আই লাভ বাংলাদেশ ২০২২ গল্প প্রতিযোগিতার ৩টি বিজয়ী গল্প

বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মার্কেটপ্লেস Bikroy.com আয়োজিত ‘আই লাভ বাংলাদেশ’ গল্প প্রতিযোগিতায় ২০০ এরও বেশি সংগৃহীত গল্পগুলো থেকে সেরা ৩টি গল্প বাছাই করে লেখদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন মোঃ ফাহাদ হোসেন ফাহিম, দ্বিতীয় হয়েছেন জুবায়ের শাওন এবং তৃতীয় হয়েছেন সাবরিনা মনসুর। গত ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২ এ বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয় এবং তাঁদেরকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হয়। বিজয়ীদের এসব গল্পে উঠে এসেছে সাহসী মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশপ্রেমিকদের দেশের প্রতি ভালোবাসা, আত্মত্যাগ আর বীরত্বের উপাখ্যান। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এবার তুলে ধরা হলো বিজয়ীদের সেসকল গল্পঃ

১. স্বাধীনতানামা

মোঃ ফাহাদ হোসেন ফাহিম

“বাজান, আর কদ্দূর? দুইদিন ধইরা না খাইয়া ধলেশ্বরীর পেটে ভাসতাছি। অথচ ধলেশ্বরীর পেট ভইরা আছে লাশে!”

“আর দুইডা ঘাঁটিতে আক্রমণ করলেই শেষ। হেরপর স্বাধীন দেশে বাপ পোলা মিল্লা পেট ভইরা খামুরে, পোকা।”

কাকজ্যোৎস্না রাতে পেছন থেকে এ ধরনের আক্রমণের প্রত্যাশা করেনি খাতির জমা অবসন্ন আর্মিরা। চোখে একেবারে সরষে ফুল দেখে মরতে হলো ভুঁইফোঁড় লোহার টুপিওয়ালাদের। বাপ বেটাকে প্রতিহত করতে গিয়ে খাবি খেয়ে যায় মিলিটারি রুই কাতলরা। ধলেশ্বরীর প্যাটরা পেট আবারও ভরে উঠেছে ভিনদেশী দস্যুদের লাশে। স্রোতঃস্বতী নধরদেহী নদীতে কচুপাতার জলের মতো মিলিয়ে পড়ে লাশের পর লাশ। তবে লাশগুলোকে ধলেশ্বরী তার পেটে ধারণ করতে চায় না। কিন্তু কেন! নদী কি কথা বলতে জানে! অথচ বাপ-বেটা দিব্যি কথা বলে নধরদেহী ধলেশ্বরীর সাথে। ধলেশ্বরীর তরঙ্গশীর্ষে স্পষ্ট হাসির নহবত। স্রোতের টানে কচুরিপানার দলের সাথে তৃণাবর্তে মিলিয়ে পড়ে সবকিছু। পাকিস্তানি মিলিটারিদের রক্তের লাল লীন হয়ে যায় ধলেশ্বরীর নীলে। অথচ স্থির থাকে ওদের আলুথালু একপায়িটা। বাওটা খুশিতে মাথা নাড়ে। নৌকার বাওটাকে পোকা বলে নড়ির পা; ডিঙির নাম রেখেছে একপায়ি। নির্বিঘ্নে স্রোতের বিপরীতে একপায়িকে নিয়ে টক্কর দিয়ে পথ পাড়ি দেয় ওরা।

ও নিজেও শিখে গেছে কিভাবে কথা বলতে হয় ধলেশ্বরীর জলপ্রবাহের সাথে। ও বলে, “ধলেশ্বরী কথা বলে, জল তার টলটলে; দস্যুদের দিব মার, টনক নড়বে এইবার।” এইতো আর মাত্র ক’টা দিন, দেশটা স্বাধীন হলে ও আগের মত ধলেশ্বরীর পিঠে সাঁতার কাটবে, গাছে উঠে বুড়ি নাচন দিবে, কানামাছি খেলবে, শিঙি মাছ ধরবে, এলেবেলে খেলবে, কড়িগাঁট্টা খাবে, জালপাদ বালিহাঁস ধরবে। যেদিন থেকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা চরে ঘাঁটি গেড়েছে, সেদিন থেকে ও এলেবেলে খেলতে পারে না। অথচ মাস চারেক আগেও মিচকি, শিমুদের সাথে এলেবেলে খেলেছে ও। সবাই বলে ও নাকি এলেবেলে খেলার রাজা। চুমকি বলে ও নাকি বিল কুমিরের ছাও। ও যখন নেউলের মত গাছের উপর উঠে বসে, তখন চুমকি ওকে খেপায় এই বলে, “বান্দর, বান্দর টেসকি, তোর ছিঁড়া লুঙ্গি দেসকি!” চুমকির কথায় ওর রাগ হয় না। গাছ থেকে এক লাফে নদীতে ডুব দেওয়ার আগে ও বলে, “এইডা অইলো এলা, আমার লগে খেলা।” এখন ও অবশ্য পাকিস্তানি দস্যুদের সাথে এলেবেলে খেলতে চায়। গাঁয়ের ঝাল ঝেড়ে ও এক হাত নিতে চায়। ও স্বপ্ন দেখে এক ডুব দিয়ে ও নিঃশেষ করে ফেলেছে পাকিস্তানি দস্যুদের ঘাঁটি।

খিদের যন্ত্রণা কলিজায় হাতুড়ি মারতেই ও বলে উঠে, “আর কুলাইতে পারি না, আব্বা। হুদা পানি খাইয়া কয়দিন আর বাঁচোন যায়।” আশেপাশে নিবিড় দৃষ্টিতে বাবা তাকিয়ে দেখে সবকিছুই শেষ। বাবা কাঁদে, কিন্তু চোখের জল ছেঁড়া লুঙ্গিতে পড়বার আগেই মনটাকে শক্ত করে ফেলে বাবা। মানুষগুলো নাই, পালিয়ে গিয়েছিল যারা তারাই বেঁচে গেছে। ফসল, মাঠ, গবাদিপশু, বাড়িঘর সবকিছু শেষ করে দিয়েছে দস্যুদের দল। পরমকতায় পারু মিয়া দাদার মুখে শুনেছে বর্গী দস্যুদের কথা। কিন্তু পাকিস্তানি দস্যুদল যে বর্গীদের চেয়েও হিংস্র। ঝোপের ডাল থেকে একটা পাকনা খাইল্যা ছেলেকে দিয়ে বলে, “চাবাইতে থাক, পোকা। দেখবি আওখের মতন লাগে।” পারু মিয়া ভাবতে থাকে কিভাবে গ্রামের মানুষ, বাজার, ঘরবাড়ি, ধানখেত, বাগান সবকিছু বিনষ্ট করে দিয়েছে পাকিস্তানি দস্যু দলেরা। সব ছিল তুলসী বনের বাঘ রাজাকার বাহিনীর কাণ্ড। শুঁড়ির সাক্ষী রাজাকার। কিন্তু কেনো ওরা এমনটা করলো! দেশের খেয়ে, দেশের পড়ে কি, দেশের বিরুদ্ধে কাজ করা যায়! কিন্তু ওরা যে পারে। রাজাকারের দল সবকিছুই পারে। মনটা ভীষণ হেঁড়ে হয়ে উঠে তখন, যখন বউ আর বেটির কথা ভাবে। নিলুফা কত স্বাদের বিবি তার! আর মাইয়্যাডা, লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি লায়লার। এক রাতেই অমরাবতী গ্রামটা নরক হয়ে গেলো! একটা সময় ওরা নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য খুব আফসোস করতো। কিন্তু এখন আফসোস নেই আর। ওরা দেখে নিখাদ আপোষের স্বপ্ন। দেশটাকে স্বাধীন করতেই হবে, তবেই মুক্তি শান্তি পাবে শহিদের আত্মারা। পাকিস্তানিরা ওদের শত্রু। তার চেয়েও বড় শত্রু ঢাকের কাঠি মানুষরূপী রাজাকার বাহিনী। আর জিততে ওদেরকে হবেই। ওরা জিতলেই জিতে যাবে দেশ।

সেদিন রাতে ধলেশ্বরী বাপ-বেটাকে বলেছিল, “বীরাঙ্গনাদের জীবন হরণকারী ডাকাতদের লাশের স্থান আমার পেট না, ওদের জায়গা হচ্ছে জাহান্নাম।” বীরাঙ্গনা কারা পোকা বোঝেনা। ওর বয়স এগারো বছর চার মাস। ঠিক চার মাস আগে জন্মদিনের দিন চুমকি ওকে একটা লাল লুঙ্গি উপহার দিয়েছিল। কিন্তু চুমকি কোথায়, তা ও ঠিক জানে না। শুনেছে চুমকি নাকি মায়ের সাথে ভারতে চলে গেছে। ও ভাবে নদীর ওপারে যেখানটায় গরম সূর্য মুখ চুইয়ে পড়ে, সেখানটাতেই ভারত। ও স্বপ্ন দেখে দেশটা স্বাধীন হলে এক ডুবে ও ভারত চলে যাবে। চুমকিকে বালিহাঁস দিয়ে নিয়ে আসবে স্বাধীন দেশে। বালিহাঁস নাকি চুমকির খুব প্রিয়। সেদিন পড়ন্ত বিকেলে ওকে ডাকতে থাকে বাবা, “এইনো দেক পোকা। লাশ, আরেকটা লাশ। বুকে দেশের পতাকা। মুন্সীগঞ্জের দিক থেইকা আইছে। এইডা মুক্তিযোদ্ধার লাশ। আয় এরে করব দেই।” ওরা লাশটাকে সযত্নে টেকের জঙ্গলে করব দিয়ে বলে, “শহিদের লাশ সম্মানের সাথে কবর দেওয়াও মুক্তিযোদ্ধাগো দায়িত্ব।”

গতকাল রাতেই পূর্ব দিকের ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়েছে ওরা। একেবারে নিঃশেষ করে দিয়েছে পাকিস্তানি দস্যুদলের আখড়া। কিন্তু আর-ও একটা আছে। এটা শেষ করলেই শেষ। ওরা ভাবতে লাগে সেদিনের কথা৷ সেদিন তো ওরাও শেষ হয়ে যেতে পারতো পাকিস্তানি দস্যুদের বুলেটের স্রোতে। কিন্তু ধলেশ্বরীর স্রোত যে ওদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ধলেশ্বরীর গেরিলা বাহিনী সমরকেন্দ্রে আক্রমণ করতেই ধূলিসাৎ হয়ে যায় পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন শমসের আলীসহ বন্দর শহরের মিলিটারি বাহিনী। বিজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু দুমুখো সাপ রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানিসহ নিজেদেরকে সমর্পণ করার ফন্দি এঁটে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বড় চাল চালে। সমর্পণ করার নামে অতর্কিত হামলা চালায় ডাকাবুকো দেশপ্রেমিকদের উপর। শুধু তাই না, সেদিন রাতে গ্রামে নির্বিচারে গণহত্যাও চালিয়েছে পাকিস্তানি নরপশুরা। বাপ বেটা একদিন আগে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মাছ ধরতে গিয়েছিল দূরে মেঘনা নদীর মোহনায়। আর ফিরে এসে দেখে সবকিছুই লুষ্ঠিত। অবশ্য সেদিনের পর থেকে পাকিস্তানিরা ভেবেছিল চর ধলেশ্বরীতে বুঝি আর কেউ বেঁচে নেই। তাই অল্প কয়েকজন সৈনিক আর রাজাকারদের নিয়ে তিনটি ঘাঁটি গেড়ে তুলেছিল এখানে। ধলেশ্বরী চর স্থল থেকে বিছিন্ন, বন জঙ্গলে আচ্ছন্ন অনেকটা বন্ধুর পথ।

বাপ-বেটা মিলে দুইটা ঘাঁটি বিনাশ করে ফেলেছে। এবারে পশ্চিমে সদর ঘেঁষা ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাতে পারলেই শেষ। তারপর দিগন্তপ্রসারী শীতলক্ষ্যা নদী। পাকিস্তানিদের সাধ্য নেই মৃত্যুর ঢেউ ঠেলে আবারও চরে ভিড়ে। তবে সেখানে বিপদ অনেক বেশি। রাজাকার বাহিনী ও মিলিটারি আর্মিরা একাকার হয়ে পাহারা দেয় নদীর সীমান্ত। তাতে কি! ওদের কাছে লাঠি আছে, কড়ই গাছের বল্লম আছে, আয়রে খোকা পাখি আছে; আছে মাছরাঙার ছোঁচালো মুখ; সবচেয়ে বড় শক্তি আছে, দেশপ্রেম। গোলাবারুদ সহ দুইটা পিস্তলও আছে ওদের। প্রথম ঘাঁটি আক্রমণ করতে গিয়ে পাকিস্তানিদেরকে মেরে উদ্ধার করে এনেছে দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা পোকা। তাইতো খুব সহজেই উড়িয়ে দিতে পেরেছে দ্বিতীয় ঘাঁটিটা। পারু মিয়া আগে মাছ মারতো, এখন মারে পাকিস্তানি দস্যু ও মীরজাফরদের। এর আগে পোকার শক্ত বল্লমের আঘাতে রাজাকার পিচ্চি প্রাণ হারিয়েছে। রাজাকার পিচ্চিকে মেরে ও বলেছিল, “এইডা অইলো এলা, আমার লগে খেলা।” কিন্তু পিচ্চির সাধ্য কি ওর সাথে খেলে! পোকা পিস্তল চালাতে জানে না। পিস্তল অনেক ভারী। অবশ্য বাবা পারে। এর আগে তিনি শিখেছিলেন। নৌ ডাকাতদের থেকে বাঁচতে বাবার কাছ থেকেই পিস্তল চালনা শিখেছিল পারু মিয়া।

স্রোতের অনুকূলে সন্তর্পণে এগুতে থাকে একপায়ি। পোকা পুত পুত শব্দ শুনে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, “এই পাখিরা পুত পুত করে কেন গো আব্বা?” “এইডা অইলো আইরে খোকা পাখি, পোলারে খুঁজে।” “কেন খুঁজে?” “নৌ ডাকাতেরা গ্রামে আইসা একবার জোর কইরা একজনের পোলারে তুইল্লা লইয়া গেছিল। পোলারে খুঁজতে গিয়া ঐ বাপ মইরা যায়। মৃত্যুর পরে নাকি হেই বাপ পাখি অইয়া জন্মাইছে। পোলাডারে এহনও খুঁজে। আর কয়, পুত পুত পুত…” ও চুপটি করে বসে থাকে। শরীর ভেঙে পড়েছে ওর। বন্য ফল, আধা কাঁচা সবজি, নদীর জলে কি আর চলে! তবুও অভিযোগ নেই ওর। আছে আপোষ, দেশকে স্বাধীন করার শক্তি। চর ধলেশ্বরী স্বাধীন হলেই স্বাধীন হবে বাংলাদেশ। ও স্বপ্ন দেখে তাই। শরীরের ভাঙন মেনে নেয়া যায়, স্বাধীনতার ভাঙন যায় না। এর আগেও চর ধলেশ্বরীতে হামলা চালিয়েছিল বান্ডারি চেয়ারম্যান। উর্বর পলিমাটি, মাছের আখরা দেখে কিছুতেই তর সইছিল না তার। রাজাকার বাহিনীকে নিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি দিয়ে সেদিনের হামলা ছিল তারই কাজ। চরের ফল, মাছ, গরুর দুধ সবকিছু পাঠিয়ে দেয় পাকিস্তানি ক্যাম্পে। কিন্তু মানুষ! পাকিস্তানিরা কি মানুষও খায়! মানুষ হয়ে মানুষকে কি খাওয়া যায়! পোকা বুঝে না সেকথা। কিন্তু বাবা বুঝে।

হঠাৎই রেডিও’র শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায় পোকার। খুশিতে আপ্লুত হয়ে বাবাকে বলে, “আব্বা, এইযে হোনো। দেশের এক মুড়া স্বাধীন অইয়্যা গেছে।” বাবা খুশি হয়ে পোকাকে জড়িয়ে ধরে আবারও বলে উঠে, “আর দুইডা দিন কষ্ট কর পোকা। হেরপর স্বাধীন দেশে বাপ পোলা মিল্লা পেট ভইরা খামু।” পোকা ঘুমিয়ে পরতেই বাবা পুতুলগুলোকে তুলে রাখে পঙ্কিল প্রান্তরের মোড় থেকে। পোকা পুতুলগুলোকে ভাবে ওর এলেবেলে খেলার সিপাহি আর ও, ধলেশ্বরী চরের রাজা, শীতলক্ষ্যার রাজা। যতদূর দৃষ্টি যায় সবকিছুই ওর। ওর করুণ শরীরে জুনিপোকারা খেলে। চপলমতি এক জুনিপোকা ওকে বলে, “দেশটা স্বাধীন হইলে আমাগো হগল আলো তোমারে দিয়া দিমু পোকা ভাই। হেই আলো দিয়া তুমি সুন্দর একটা জামা কিনবা।” পোকা কাঁদে। নদীর তীরে ঘাসের উপর শুয়ে ওর মনে হয়, “কি সুন্দর পৃথিবী, কি সুন্দর আকাশ, কি সুন্দর জীবন, কি সুন্দর স্বাধীনতা!”

রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানিরা যেদিন চরে আক্রমণ করে, সেদিন গ্রামে ছিল মেলা। পুতুল নাচের সব পুতুলগুলোকে পাকিস্তানিরা যখন নদীতে ফেলে দেয়, সেগুলো আটকা পড়ে কচুরিপানার ঝোপে। আর ওরা তুলে রেখে দেয় নৌকায়। এতে অবশ্য একটা ফায়দা হয়েছে ওদের। রাতে যখনই ওরা পাকিস্তানিদের ঘাঁটিতে অভিযান চালানো শুরু করতো, তখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুতুল বসিয়ে রাখতো। এতে করে পাকিস্তানি আর্মিরা ভুল জায়গায় গুলি ছুড়তো আর ভাবতো এখনো বুঝি অনেক মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছে গ্রামে। এভাবেই ভয়ে ভয়ে অনেক রাজাকার পালিয়ে বেঁচেছে চর ছেড়ে।

বাবা ওকে বলে, “হোন পোকা। ফজরের আগেই পশ্চিম ঘাঁটিতে আক্রমণ চালামু।” আক্রমণের কথা শুনে ও খুব খুশি হয়। কারণ দেশটা স্বাধীন হলে ও পেট ভরে খেতে পারবে, দেশের মানুষও খাবে পেট ভরে। অবশ্য আক্রমণ করার আগে ওকে অনেক বেশি কাজ করতে হয়। গভীর রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে ও চলে আসে সদর ঘেঁষা পশ্চিম ঘাঁটিতে। দূর থেকে দেখে, লোহার টুপি মাথায় দিয়ে পাহারা দিচ্ছে সেপাইয়ের দল। ও বলে কেয়াপাতার সেপাই। দূরে দূরে সাদা পুতুলগুলো সাজিয়ে রেখে চলে আসে ও। কিন্তু ফিরতে খুব কষ্ট হয়। অন্ধকারে কাঁদায় পা দিতেই শামুকে কেটে যায় পা। ও নীল প্লাস্টিক দিয়ে বেঁধে রাখে পা’টা। গতরাতে বৃষ্টি হয়েছে খুব। অবশ্য এখন বৃষ্টি নেই। নৌকা থেকে নেমে বাবা যখন বন্দুক নিয়ে মিলিটারি ঘাঁটিতে আক্রমণ করে, তখন ও গাছের উপর উঠে বল্লম ছুঁড়ে মারে। এর আগে রাজাকার পিচ্চি সহ বিশজন পাকিস্তানি মিলিটারি প্রাণ হারিয়ে ওর বল্লমের আঘাতে। সেবার সময়মত বল্লম ছুঁড়ে না মারলে তো ধরাই পড়ে যেতো বাবা। আর মাত্র একটা ঘাঁটি। তারপর একটা দেশ, একটা জাতি, একটা লালিত স্বপ্ন, একটা স্বাধীনতা। কাঁধে দশটা বল্লম আর মাথায় লোহার টুপি দিয়ে সন্তর্পণে গাছে উঠে পড়ে পোকা। মিলিটারিরা টের পায় না। একশো কেয়াপাতার সেপাই আর বান্ডারি চেয়ারম্যান সহ দশ বারো জন রাজাকারের বেশি মানুষ হবে না ঘাঁটিতে। ছেঁড়া লুঙ্গিটায় শক্ত করে কাছার বেঁধে বের হয় বাবা। পিস্তল একটা হাতে, আরেকটা কাঁধে।

গাছের উপর থেকে সূচালো বল্লমটা ছুড়ে মারতেই বিঁধে যায় পাহারারত সৈনিকের বুকে। ঝোপের আড়াল থেকে তাক করে গুলি ছুড়তে শুরু করে দেয় বাবা। দশজন সৈনিক বেহুঁশ। মরে গেছে একেবারে। অবিশ্রান্তভাবে পাকিস্তানি মিলিটারিরা গুলি চালাতে থাকে সাদা রঙের পুতুলগুলোর দিকে। ঝোপের আড়াল থেকে গুলি চালাতে থাকে বাবাও। ওর ছয়টা বল্লমে ছয়জন শেষ। এর মধ্যে দুইজন রাজাকার। একেবারে চিঁড়ে গেছে বান্ডারি চেয়ারম্যানের লালচে কলিজাটা। এদিকে গুলি করতে করতে দুর্নমিতভাবে এগিয়ে যেতে থাকে বাবা। ওর কাছে এখন একটা বল্লমই আছে। উপর থেকে নিশানা করতে গিয়ে পিছলা গাছের ওরসা মগডাল থেকে নিচে পড়ে যায় ও। ভেঙে যায় বা হাতটা। কিন্তু কাদায় শুয়ে ও ডান হাত দিয়ে বল্লমটা খুব জোরে ছুড়ে মারে। একেবারে বিঁধে যায় লোহার টুপিওয়ালা সৈনিকটার বুকে। কিন্তু সৈনিকের পিস্তলের গুলিও এসে আঘাত করে ওর অকুটিল হৃদয়টাতে। এদিকে বাবার কাছে চিরদিনের জন্য কুপোকাত হয়ে পড়ে রাজাকারসহ পাকিস্তানি মিলিটারির দল। সব মরে একেবারে নিষ্প্রভ ভূত। ও চেয়ে থাকে অপলক। বাবা জোরে জোরে বলে উঠে, “জয় বাংলা, বাংলার জয়।” জোর গলায় ও নিজেও বলতে চেষ্টা করে, “জয় বাংলা, বাংলার জয়।” ওর শব্দ বাবার কানে পৌঁছায় না। বাবা ওকে খুঁজতে খুঁজতে বলতে থাকে, “পোকারে, কইছিলাম না স্বাধীন দেশে বাপ পোলা মিল্লা পেট ভইরা খামু.. তুই কই গেলি পোকা?…” কিন্তু বাবা খুঁজে পায় না ওকে। উপর থেকে পড়ে হাত, পা ভেঙে যাওয়ায় উঠে দাঁড়াতে পারে না পোকা। কাটা পায়ের রক্তে আরও রক্তিম হয়ে উঠেছে ওর কাছার দেওয়া লাল লুঙ্গিটা। পূর্ব দিগন্তের মেঘগুলো মিলিয়ে পড়ছে কাঁদতে কাঁদতে, দিগন্তে স্বাধীনতার আলোক সমারোহ ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। স্বাধীনতার মোলায়েম আলো গায়ে লাগতেই ও বলে উঠে, “এইডা অইলো এলা, পাকিস্তানি গো লগে খেলছি আমি খেলা।” বিরান আকাশের মেঘ চিঁড়ে হাসিমুখে উড়ে যেতে থাকে ওর তন্ময় প্রাণবায়ু। জুনিপোকার দল সর্বশক্তি দিয়ে আটকে ধরে ওকে আর তেজোদৃপ্ত কণ্ঠে বলে, “দেশের জন্য জীবন দিয়া লাল করলো যে নিজের জামা, শহিদ পোকার মৃত্যু নাই, পোকার নামেই স্বাধীনতানামা।”

২. যে দিন ছিল আগুনের

জুবায়ের শাওন

মানুষকে কত প্রকারে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা যায় সেসব পরীক্ষার জন্য একটা যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়ে ভাল ল্যাবরেটরি হয়তো আর নেই। এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল একটা উদাহরণ হতে পারে হলোকাস্ট (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর দ্বারা ইহুদীদের ওপর চালানো গণহত্যা।) দ্বিতীয় ল্যাবরেটরি তাহলে কোনটি? একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ? কে জানে!

মজিবর রহমান সরকার গ্রামের মানুষজনের কাছে মোটামুটি চেনা-পরিচিত মুখ। বোনারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার সে। মানুষজন ভালোবেসেই তাকে ভোট দিয়েছে। ভোটের জন্য মানুষের খুব একটা হাত পা ধরতে হয় নাই তাকে। তবে অনেকদিন ধরেই তার নামে কিছু উড়ো কথা শোনা যায়। কেউ কেউ বলে যুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথেই এই লোক ইন্ডিয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। কেউ কেউ আবার বলে, ট্রেনিং ঠিক না। তবে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রোস্তম আলীর সাথে তার ভালোই ওঠাবসা। স্বাধীন পাকিস্তানের একটা লোক ভারতের একটা দালালের সাথে ওঠবস কিভাবে করতে পারে? তাও আবার ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মানুষ! তবে এই লোক যে সলিড দেশপ্রেমিক না এই ব্যাপারে সবাই মোটামুটি নিশ্চিত। বিশেষ করে এত দুর্যোগের মধ্যেও যারা পাকিস্তানের পবিত্র স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য ভারতের দালালদের সাথে প্রাণপণে লড়াই করে যাচ্ছে তাদের কাছে মজিবর রহমান সরকারের বদমায়েশির ব্যাপারটা মোটামুটি নিশ্চিতই।

শুধু মজিবর রহমান সরকারই না। আরও কয়েকজন নজরদারিতে আছে। তাদের কারও কারও যুদ্ধে যোগদানের ব্যাপারটা নিশ্চিত। কয়েকজনকে নিয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। তবে এটা খুব বড় কোন ব্যাপার না। একবার ক্যাম্প পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলেই হল। বাকি স্বীকারোক্তি যথাযথ আদর-আপ্যায়নের মাধ্যমে আদায় করার সুব্যবস্থা সেখানে আছে।

বুধবারের সকাল। নভেম্বর মাস, ১৯৭১।

শীতকাল তার কুয়াশা আর শীতলতার চাদর কেবল বিছাতে শুরু করেছে। তবে আবহাওয়া ঠাণ্ডা থেকে কোন লাভ হয়নি, পরিস্থিতি যথারীতি পূর্বের মতনই গরম। সেই গরম পরিস্থিতিকে আরও একটু উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বোনারপাড়া ইউনিয়নের শিমুল তাইড় গ্রামের মধ্যপাড়ায় ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়েছে। এই ধরপাকড়ে পাক বাহিনীর সাথে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় আছে মূলত স্থানীয় বিহারীরা। বাঙালীরা এদের চোখের বিষ। সেই বিষ নামাতে দু’চারজন ছিঁচকে কোলাবোরেটরও (রাজাকার) আছে।

রক্তাক্ত সেই ধরপাকড় অভিযানে ধরা পড়লো ৩০ জন। তাদের সবাইকে নিয়ে আসা হয়েছে বোনারপাড়া জংশনের লোকোশেডে। মেজর সাহেব সকাল থেকে অপেক্ষা করে আছেন। অভিযানের খবরে উনি খুবই আনন্দিত। এর মধ্যে অনেক জায়গায় ভারতীয় দালালবাহিনীর হামলা হয়েছে। সেসব জায়গায় কিছু ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। তবে এরকম দু’চারটা দালাল ধরতে পারলে সেসব ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে খুব বেশি দুঃখবোধ হয়না। এদিকে নিরীহ সাধারণ মানুষের যেন কোন প্রকার ক্ষতি না হয় সে ব্যাপারে মেজর সাহেব আবার খুবই সচেতন! নানাভাবে এই ৩০ জনের পরিচয় নিশ্চিত হবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। এজন্য লোকোশেডের হেড, বড় বাবু আছির উদ্দিন সরকারকে নিয়ে আসা হয়েছে। একেবারেই নিরীহ, সাদাসিধে মানুষ, কারও সাতে-পাঁচে থাকেন না। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পরও তার থেকে তেমন কোন তথ্য পাওয়া গেল না। শুধু জানালেন, তিনি তো সরকারের চাকর। এসব যুদ্ধে-টুদ্ধে যাবেন কেন? মুক্তিযোদ্ধাদেরই বা চিনবেন কিভাবে? শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে আছির উদ্দিন সরকারকে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসা হল।

তবে খুব বেশি সময় লাগলো না। ৩০ জনের ভেতর ১৩ জনের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকি ১৭ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই ১৭ জন হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষদের দলভুক্ত। কিন্তু বাকি ১৩ জন?

এই ১৩ জনের ভাগ্য খুব একটা সুপ্রসন্ন হল না। সকাল থেকে ফুরফুরে মেজাজে থাকা মেজর সাহেবের হঠাৎই খুব রাগ হল। শুরু হল অকথ্য নির্যাতন। কারও হাত-পা থেঁতলে দেওয়া হল। কারও সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত করা হল। সে সময় এই মানুষগুলো কি ভাবছিলেন? তারা কি কোনভাবে বাঁচার আশা খুঁজছিলেন? সর্বশক্তিমানের ঘটানো হঠাৎ কোন একটা মিরাকলের অপেক্ষা কি করছিলেন তারা? কে জানে! কিন্তু এই হতভাগা মানুষগুলো হয়তো ভুলেও চিন্তা করেনি সূর্য ডোবার পরের আধারটা তাদের জন্য কতটা ভয়ানক হতে পারে।

সারাদিন অকথ্য নির্যাতনের পর মৃতপ্রায় মানুষগুলোকে ফেলা হল রেলওয়ের কয়লা চালিত ইঞ্জিনের বয়লারের ভেতর। মানুষগুলো তখনও মরেনি। কয়েকজনকে হাত পা কেটে ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল! হিটলারের হলোকাস্ট কি এমন ছিল? সেখানে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মানুষ হত্যা করা হত, গুলি করে মেরে ফেলা হত, পিটিয়ে মেরে ফেলা হত, মরে যাবার পর মৃতদেহগুলো পুড়িয়ে ফেলা হত। কিন্তু জীবন্ত কাউকে কি কখনও পোড়ানো হয়েছিল সেই হলোকাস্টে? জানা নেই।

বোনারপাড়া রেলওয়ে লোকোশেডে ফিরে আসি।

এখানে ১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বরের রাতটায় চলছিলো হিটলারের নির্মমতাকে হার মানানো এক হত্যাযজ্ঞ। পিটিয়ে প্রায় থেঁতলে দেওয়া শরীরের রক্তাক্ত ক্ষতগুলো সেদিন ঢাকা পড়ে গেল বয়লারের জ্বলন্ত শিখায়। বয়লারের ভেতরে পুড়তে থাকা মানুষগুলো তখনও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েনি। বাঁচার আকুতিতে চলতে লাগলো তাদের বুকফাটা আর্তনাদ, কখনও ‘পানি-পানি’ বলে চিৎকার! এভাবে পোড়া কণ্ঠগুলো একসময় নিস্তব্ধ হল। নিস্তব্ধ দেহগুলোও পুড়ে অঙ্গার হল। একটা গণকবর পাবার মতন ভাগ্যও হল না ১৩ জন মানুষের। যে দেহ ছাই হয়ে মিশে গেছে রেলওয়ে ইঞ্জিনের জ্বলন্ত বয়লারের কোণায় কোণায়, সে দেহ কবরের ঠিকানা খুঁজে আর কিই বা করবে!

পুনশ্চঃ ১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর বোনারপাড়া রেলওয়ে লোকোশেডের আর্মি ক্যাম্পে নিহত ১৩ জনের নাম জানা যায়। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশটার স্বাধীনতার জন্য জীবন দেওয়া হতভাগ্য সেই ১৩ জন মানুষ হলেনঃ

১. শহীদ মজিবর রহমান সরকার (ইউপি সদস্য)

২. শহীদ মোহাম্মদ আলী

৩. শহীদ মনসুর রহমান

৪. শহীদ আতিয়ার রহমান আতা

৫. শহীদ আয়েজ উদ্দিন

৬. শহীদ মহির উদ্দিন

৭. শহীদ সহির উদ্দিন

৮. শহীদ আব্বাস উদ্দিন

৯. শহীদ ইনছুর আলী

১০. শহীদ লাল মিয়া

১১. শহীদ আইজাল মুনশি

১২. শহীদ সরাফ উদ্দিন

১৩. শহীদ নসিম উদ্দিন।

আমাদের এই দেশটা এমন এক দেশ যার রয়েছে নয় মাসের রক্তের ইতিহাস। এই রক্তের ইতিহাস এতটাই নির্মম, নৃশংস তা হয়তো হাজারটা শব্দ দিয়েও কোনদিন বর্ণনা করা সম্ভব না। এ নৃশংসতা এতটাই ভয়ংকর তা সকল কল্পনাকে হার মানায়, গল্প-উপন্যাসের গন্ডি ছাড়িয়ে সকল ভাষাকে নির্বাক করে দেয়। যে দেশ এতটা আগুনের পথ পাড়ি দিয়ে স্বাধীন হয়েছে আসুন সেই দেশটাকে আমরা ভাল রাখি। আসুন না, নাম জানা-অজানা লাখো বীর শহীদের প্রতি খানিক শ্রদ্ধা জাগিয়ে হলেও এই দেশটাকে আমরা নিজের মায়ের মত করেই আগলে রাখি।সন্তান হয়ে মাকে ভালো রাখার মত শান্তি আর কিছুতেই নেই।

৩. বিভেদ

সাবরিনা মনসুর

একটু পরই শালিশ শুরু হবে, শালিশ নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই, বরং শালিশের পরই শুরু হবে আসল খেলা। দুই পক্ষই ভেতরে ভেতরে যুদ্ধের প্রস্ততি নিয়ে রেখেছে। এখন যুদ্ধের আগের থমথমে অবস্থা।

মতলব খাঁ ভেতরে ভেতরে খুবই খুশি, এখন পর্যন্ত সবকিছু উনার পরিকল্পনা মতই চলছে, উনি গোটা নাটকের চিত্রনাট্য সাজিয়ে রেখেছেন, এখন তার চিত্রায়নও হচ্ছে, শুধু শেষ দৃশ্যই বাকি।

ইমাম আলী লোকটা নামাজ শেষ করে আসলেন, উনি আবার কখনো নামাজ কাযা করেন না। কিছুক্ষণ আগেও এত গুনগুন শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু উনি আসার সাথে সাথেই সবাই চুপ হয়ে গেল। লোকটাকে সবাই যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে, আচার আচরণের কারণেই হয়তো ।

মতলব খাঁও একটু নড়েচড়ে বসলেন। ইমাম আলী লোকটার দিকেও আড়চোখে তাকালেন দুয়েকবার, লোকটাকে বেশ ভালো অভিনেতাই মনে হচ্ছে। এই যে কিছুক্ষণ আগের এত বড় একটা ঘটনা ঘটলো তার রেশ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছেনা। যদিও লোকটাকে মতলব খাঁর মোটেও পছন্দ ছিলনা, কিন্তু লোকটাকে দলে টানতে পারলে বিজয় যে একদম নিশ্চিত এতে কোন সন্দেহ ছিলনা কখনোই।

ও বলা হয়নি, মতলব খাঁ গৌরীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যান কম হর্তা-কর্তাই বলা চলতো। পুরো গৌরীপুর উনার কথায় চলতো। উনি বেশ কিছু নাটক সাজিয়ে গৌরীপুরের মানুষদের কলের পুতুল বানিয়ে রেখেছিলেন, এরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে এত মারামারি হানাহানিতে থাকতো যে অন্য কোন সমস্যার কথা চোখেই পড়তো না, আর ঐ সুযোগে মতলব খাঁ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন, এই গ্রামের মানুষগুলো আসলে কোন কাজেই আর এক হতে পারতোনা, শেষে দেখা যেত সরকার থেকে যে উন্নয়ন বরাদ্দ আসতো সবটা মতলব খাঁর পকেটেই যেত।

এভাবেই চলছিল বেশ। ঐ পঙ্কজ হাওলাদার এসে সব তালগোল পাকালেন। গ্রামের একটাই স্কুল ছিল, যেটার হেড মাস্টার থেকে শুরু করে শিক্ষক সবই মতলব খাঁর লোকজন, বাচ্চাগুলোর আর আগ্রহও হতোনা স্কুলে যাবার।

পঙ্কজ হাওলাদার লোকটা শহরের দিকে শিক্ষকতা করতো, গ্রামের অবস্থা দেখে নিজ উদ্যোগেই ছেলেমেয়েদের পড়ানো শুরু করেন। প্রথম প্রথম কেউ আসতে না চাইলেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজনদের সাথে কথা বলে আসেন, এসব মোটেও সহ্য হচ্ছিলনা মতলব খাঁর। গ্রামের লোকগুলোও কেমন মারামারি বাদ দিয়ে যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল।

এরপর তো আরো ভয়ানক ব্যাপার ঘটলো, চেয়ারম্যান নির্বাচনে যেখানে মতলব খাঁ এতদিন বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জয়ী হয়ে আসছে, এবার কয়েকজন মিলে পঙ্কজ হাওলাদারকেও নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিল।

মতলব খাঁর সাম্রাজ্যে অন্য কেউ আসবে তিনি সইবেন কিভাবে? বেশ নড়েচড়ে উঠলেন। শুরু করলেন নতুন নাটক। বহু হিসেব কষে দেখলেন গৌরীপুরে হিন্দু মুসলমান অনুপাতে মুসলমানরা বেশ এগিয়ে। কোনভাবে যদি এদের মধ্যে একটা দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেওয়া যায়, মুসলমান কেউ আর হিন্দু পঙ্কজ হাওলাদারকে ভোট দেবেনা, মুসলমানদের ভোটে মতলব খাঁ হেসে খেলেই জিতবে।

এরপর শুরু হলো নাটক,এই কুরবানীর ঈদে রাতের আঁধারে গরুর ভূড়ি, রক্ত সব গ্রামের হিন্দু বাড়িগুলোর সামনে ফেলে আসা হলো, যদিও কাজটা মতলব খাঁর একার, কিন্তু হিন্দুরা বেশ খেঁপে উঠেছে। পুরাতন মন্দিরটাকে ভেঙে ওখানে মসজিদ করা হচ্ছে নতুন করে, যদিও এতে ইমাম আলীর ঘোর আপত্তি ছিল, কিন্তু তার কথা কেন শুনবে মতলব খাঁ?

এরপর চূড়ান্ত কাজটা হয়েছে গতকাল রাতে। হিন্দুদের দূর্গাপূজা সবে শুরু হলো। গৌরীপুরে বেশ আয়োজন করেই এই পূজা হয়, রাতের আঁধারে কারা যেন কুরআন শরীফ হনুমানের পায়ে রেখে এসেছে। আর সেই ক্ষোভে মুখ বেঁধে কয়েকজন পূজা মণ্ডপ ভাঙচুর করে এসেছে, বেশ কয়েক জায়গায় লুটপাট আর আগুন দেওয়ার প্রস্ততিও চলছে বলে ভয়ে আছে অনেকে, একদিকে চাপা উত্তেজনা, আরেকদিকে যুদ্ধ পূর্ববর্তী থমথমে অবস্থা। গৌরীপুরের মুসলিম লোকজন বেশ ক্ষেপেছে, এর একটা বিহিত করতেই হবে। আজ তাই শালিশ বসেছে।

অন্য যেকোন কিছুর সিদ্ধান্ত মতলব খাঁই দিত। কিন্তু উনি বেশ পাকা খেলোয়াড়, উনি ইমাম আলীকে ধরে এনেছেন শালিশের বিচার করতে। এখানেও অবশ্য তিনি ইমাম আলীকে তার হাতের পুতুল হিসেবেই ব্যবহার করতে চান। লোকটা ভালো হওয়ায় মুসলমান লোকজন সবাই উনার একনিষ্ঠ ভক্ত। উনার যেকোন কথা চোখবন্ধ করে বিশ্বাস করবে। মতলব খাঁ অবশ্য উনার সাথে শালিশের আগেই একবার গোপনে কথা বলেছেন। উনাকে বলেছেন শালিশে কিছু উস্কানিমূলক কথা বার্তা বলতে, এই যে মূর্তিপূজা হারাম, শয়তানের কাজ কারবার, গৌরীপুরে এসব হলে আজাব নেমে আসবে, এইসব কথা বলে দেবেন, গৌরীপুরে আর একটাও হিন্দু আস্ত থাকবেনা। ইমাম আলী কিছুই বললেন না, শুধু জিজ্ঞেস করলেন গতরাতের কাজটা কি আপনার? মতলব খাঁ পান চিবুতে চিবুতে সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে এক বান্ডিল টাকা বের করে ইমাম আলীর হাতে দিলেন। ইমাম আলী লোকটা অনেকক্ষণ টাকার বান্ডিলটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, এত টাকা একসাথে উনি কখনো দেখেননি।

শালিশ শুরু হবার আগেই মতলব খাঁ পরবর্তী সবকিছু কল্পনা করে রেখেছে, ইমাম আলীর কথা শেষ হলেই মুসলিম লোকগুলো গিয়ে গ্রামের সব মন্দির ভেঙে আসবে, আগুনে পুড়বে ঘরবাড়ি, লুটপাট হবে। কয়েকটা মেয়ের ধর্ষণও হতে পারে। হিন্দু লোকগুলো আসবে নতুন মসজিদটা ভাঙতে, নিজেরা কয়েকটা মারামারি করে নিজেদের হাড়গোর ভাঙবে, হিন্দু-মুসলমান দুই ভাগ হবে, ভোটে প্রত্যেকটা মুসলিম ইচ্ছা না থাকার সত্বেও মতলব খাঁ কে ভোট দিবে। এরপর অবশ্য ইমাম আলীরও একটা ব্যবস্থা করতে হবে, কোনদিন আবার সেও নির্বাচনে দাঁড়ায়ে যায়, ঠিক ঠিকানা নাই।

পুরোহিত সাহেব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে গতকালের সব বর্ণনা দিলেন, পাগলের মত এক লোক এসে মাঝরাতে কুরআন শরীফ রেখে গেছে, এর কিছুক্ষণ পরই টুপি পাঞ্জাবী পড়ে মুখ বেঁধে আসা একদল লোক কাজটা করেছে। হিন্দু-মুসলমান দুপক্ষের লোকগুলো বেশ ফুঁসেই উঠেছে। ইমাম আলী লোকটা খুব সুন্দর করে বললেন হিন্দুদের প্রধান উৎসব দূর্গাপূজা। কেউ জেনে বুঝে এমন করবেনা, হয়তো এটা তৃতীয় পক্ষের কারোই কাজ। আর পবিত্র গ্রন্থ অবমাননার মত অপরাধ যে করেছে শাস্তি শুধু তারই প্রাপ্য, নিরপরাধ কেউ যেন শাস্তি না পায়, সে দিকটা নিয়েও বললো। একইসাথে বেশ কিছু হাদিস আর আয়াতের ব্যাখ্যা করলেন। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যে ইসলাম ধর্মে নিষেধ সেটাও বুঝিয়ে বললেন। মহানবী যখন মদিনায় গিয়েছিলেন ওখানেও অন্য ধর্মের লোক ছিল, কারো উপর তিনি জোর করেনাই।

গতকালকের কাজটা আসলেই খারাপ হয়েছে, তিনি টাকার বান্ডিলটা বের করে পুরোহিতের হাতে দিলেন, গৌরীপুরের লোকজনের হয়ে ক্ষমা চাইলেন, এই টাকা দিয়ে আশা করি অনেক ভালো আয়োজন হবে, আর মুসলমান কয়েকজনকে দায়িত্ব দিলেন এই হিন্দু লোকগুলো আপনাদের ভাই, দেখবেন এদের যেন কোন অসুবিধা না হয়, পরিস্থিতি এখন ভালোনা, যেকোন সময় একটা দাঙ্গা হাঙ্গামা পাল্টা আঘাত আসতে পারে, এরা আপনাদের-আমাদের আমানত, এদের যেন কোন অসুবিধা না হয় উৎসবে। হিন্দু লোকজন আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো, গ্রামের হিন্দু-মুসলিম পাড়া প্রতিবেশি এতদিন যাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল, কোলাকোলি করে উঠলো।

সবার চোখ মুখে যেখানে আনন্দ ঝকঝক করছিল, মতলব খাঁর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো, ইমাম আলীকে এর শাস্তি পেতেই হবে।

ইমাম আলী যাওয়ার আগে মতলব খাঁয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে গেলেন, বলে গেলেন তার ধর্মে এসব দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধানো স্পষ্ট নিষেধ, তাই উনি মতলব খাঁর কথাটা রাখতে পারলেন না।

গত কয়েকদিনে গৌরীপুরে সবকিছু বদলে গেছে, ক্ষণে ক্ষণে ঢাকের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আবার আজানের সময় সেটা সাময়িক বন্ধও থাকছে, আরো দুইবার মুখবাঁধা দুবৃত্তের দল মন্দিরে গিয়েছিল ভাঙচুর করতে, কিন্তু মন্দিরের সামনে মুসলিম লোকজন রাত-দুপুরে করে করে পাহাড়া বসিয়েছে।

নবমীর রাতের বেলা, ঢাকের আওয়াজ বেশ গাঢ় হচ্ছিল, ঐ আওয়াজে ইমাম আলীর ক্ষীণ গলাটা শোনা যাচ্ছিলনা, মুখ বাঁধা একদল লোক উনার গলায় ছুরি চালায়, উনার গোঙানির শব্দ শুনে, পূজা দেখে ঘরে ফেরা একদল কিশোরী ছুটে আসে…

পুরো গৌরীপুরে শোরগোল পড়ে যায়, পূজা ফেলে পুরোহিত মশাই থেকে শুরু করে গ্রামের অর্ধেক লোকজন সদর হাসপাতালে ভীড় জমায়, বাকি অর্ধেক লোকজন হয়তো দোয়া আর প্রার্থনায় ইমাম আলীর আরোগ্য কামনা করতে বসেছে।

পুরোহিত মশাই রক্ত দিচ্ছেন ইমাম আলীর জন্য, হিন্দু-মুসলমান রক্ত মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে, ঐদিকে মসজিদ-মন্দিরে ইমাম আলীর জন্য প্রার্থনা বসেছে, এই লোকটা গৌরীপুরকে এক করার মত কঠিন কাজটা করেছে, উনাকে যে এত সহজে মৃত্যুর কাছে হারতে দেওয়া যায়না।

একবছর পর, গৌরীপুর একদম বদলে গেলো, ইদ কিংবা পুজো গৌরীপুরের মানুষ একসাথে উৎসবের রঙে মেতে উঠে।

ঠিক এইরকমভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন ধর্মপ্রাণ মানুষেরা বিভেদের রেখা ভুলে দেশের জন্য এক হয়েছিলো বলেই আমরা পেয়েছি এই স্বাধীনতা।

Facebook Comments
সাবস্ক্রাইব করুন

No spam guarantee.

Show More

Related Articles

Back to top button
Close
Close