যানবাহন

চালকদের জানা উচিত এমন ১০টি গুরুত্বপূর্ণ গাড়ির পার্টস

সচেতন চালকদের, গাড়ির মৌলিক পার্টস সম্পর্কে ধারণা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু গাড়ি চালাতে পারলেই দক্ষ চালক হওয়া যায় না। গাড়ি চালানো শুধুমাত্র স্টিয়ারিং এবং এক্সিলারেটর অপারেট করে গন্তব্যে পৌঁছানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এছাড়াও গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ এবং লং-লাস্টিং পারফরম্যান্স পেতে গাড়ির পার্টস সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা থাকা জরুরি। গাড়ির বিভিন্ন অংশের কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকলে তৎক্ষণাৎ রিপেয়ার সহ যেকোনো পরিস্থিতি সামলানো সহজ হয়।

গাড়ির ইঞ্জিন, ট্রান্সমিশন, ব্রেক, সাসপেনশন থেকে শুরু করে ছোট ছোট পার্টস যেমন – হেডলাইট বা ওয়াইপার – সবই চালকের জানা থাকা দরকার। এই ব্লগে চালকদের জানা উচিত এমন ১০টি গুরুত্বপূর্ণ গাড়ির পার্টস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। হঠাৎ কোনো ছোটখাটো সমস্যা দেখা দিলে কিংবা জরুরি পরিস্থিতিতেও, এই জ্ঞানই চালককে তাৎক্ষণিক সমাধান খুঁজে পেতে সহায়তা করতে পারে।

(১) ইঞ্জিন মেকানিজম

ইঞ্জিন যেকোনো মোটরচালিত বাহনের প্রধান অংশ। একটি গাড়ির হার্ট হলো ইঞ্জিন। এটি ফুয়েল থেকে পাওয়ার প্রডিউস করে, অর্থাৎ জ্বালানিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করে। গাড়ির ইঞ্জিন বিভিন্ন ধরণের হতে পারে – পেট্রোল, ডিজেল, হাইব্রিড, সিএনজি, ইলেকট্রিক, ইত্যাদি।

একজন চালকের পুরো ইঞ্জিন মেকানিজম সম্পর্কে ধারণা রাখা কঠিন। তবে সাধারণ কিছু বিষয়ে অবশ্যই ধারণা থাকা প্রয়োজন। যেমন – ওভারহিটিং, থার্মোস্ট্যাট, ব্যাটারি ডেড, ইগনিশন সিস্টেম, স্পার্ক প্লাগ, অয়েল লিক, ফিল্টার, কার্বন জমে যাওয়া, ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা থাকা প্রয়োজন। এসব সাধারণ যান্ত্রিক সমস্যা ইঞ্জিনের কার্যকারিতা এবং কার্যক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে।

(২) ক্লাচ

ম্যানুয়াল সিস্টেম গাড়িতে ক্লাচ অপরিহার্য একটি অংশ। এটি গিয়ার পরিবর্তনের সময় ইঞ্জিন ও গিয়ারবক্সের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সাহায্য করে। এটি গাড়ির গতি পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ক্লাচ ঠিকঠাক থাকলে গিয়ার পরিবর্তনের সময় ধাক্কা বা ঝাঁকুনি লাগে না। তাই নিয়মিত ক্লাচ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। একজন চালকের, ক্লাচ স্লিপ করার লক্ষণ, ক্লাচ প্লেট-ডিস্ক-স্প্রিং, ক্লাচ কেবল, ক্লাচ গ্র্যাবিং, ক্লাচ রিলিজ বেয়ারিং, ক্লাচ হার্ড হওয়া, ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা থাকা উচিত।

(৩) ব্যাটারি সিস্টেম

ব্যাটারি গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নিতে এবং সকল ইলেকট্রিক সিস্টেম (যেমন – হেডলাইট, ইনফোটেইনমেন্ট সিস্টেম, ইলেকট্রনিক ডিভাইস, ইত্যাদি) চালু রাখতে সাহায্য করে। ব্যাটারি চার্জ এবং কানেকশন নিয়মিত চেক করা না হলে, ব্যাটারি হেলথ দ্রুত কমে যায়। একজন চালকের ব্যাটারির সার্কিট সমস্যা, ব্যাটারি সেল, অতিরিক্ত গরম হওয়া, অক্সিডেশন/কার্বন জমে যাওয়া, অল্টারনেটর সমস্যা, ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত।

(৪) ব্রেক সিস্টেম

ব্রেক সিস্টেম গাড়ি থামাতে এবং গতি কমাতে ব্যবহৃত হয়। এটি গাড়ির নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। ব্রেকিং সিস্টেমে ডিস্ক, ড্রাম, ব্রেক প্যাড, ফ্লুইড ইত্যাদি থাকে। ব্রেক প্যাড, ব্রেক ফ্লুইড লিক, হাইড্রোলিক প্রেসার, ব্রেক ক্যালিপার স্টাক, ব্রেক লাইন ব্লক বা কনটামিনেশন, এন্টিলক ব্রেকিং সিস্টেম, ইত্যাদি নিয়মিত পরীক্ষা করা হলে ব্রেক সিস্টেম দীর্ঘ দিন ভালো থাকে।

(৫) স্টিয়ারিং সিস্টেম

স্টিয়ারিং হুইল গাড়ির দিক পরিবর্তন এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি ম্যানুয়াল বা পাওয়ার স্টিয়ারিং ধরণের হতে পারে। চালকের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি গাড়ির নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। স্টিয়ারিং শক্ত কিংবা খুব বেশি ঢিলা হয়ে থাকা, স্টিয়ারিং বেয়ারিং সিস্টেম, স্টিয়ারিং গিয়ার ফ্রিকশন, স্টিয়ারিং ফ্লুইড সমস্যা, ইত্যাদি সম্পর্কে চালকের ধারণা থাকা উচিত। স্টিয়ারিং সিস্টেমে সমস্যার কারণে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

(৬) সাসপেনশন সিস্টেম

সাসপেনশন রাস্তার স্পিড ব্রেকারের ধাক্কা অ্যাবজর্ব করে স্থিতিশীলতা বজায় রাখে এবং আরামদায়ক ড্রাইভ নিশ্চিত করে। সাসপেনশন সিস্টেমের মধ্যে বিভিন্ন পার্টস যেমন: শক অ্যাবজর্বার, স্ট্রাট, বল জয়েন্ট, বুশিং, এবং স্প্রিংস অন্তর্ভুক্ত। নিয়মিত সাসপেনশন চেক করা এবং শক অ্যাবজর্বার, স্প্রিং ও বল জয়েন্ট সময়মতো পরিবর্তন করা হলে সাসপেনশন ঠিক থাকে।

(৭) ফুয়েল পাম্প ও ফুয়েল ইনজেকশন সিস্টেম

গাড়ির ফুয়েল পাম্প ও ফুয়েল ইনজেকশন সিস্টেম, ফুয়েল ট্যাংক ইঞ্জিনে জ্বালানি সরবরাহ করে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। ফিউজ পাম্প পুড়ে যাওয়া, নিম্নমানের জ্বালানি, লো ফুয়েল প্রেসার, ফুয়েল ফিল্টার বন্ধ হওয়া, ইনজেক্টর ক্লগ হওয়া, ফুয়েল ইনজেক্টর লিক করা, ইত্যাদি সমস্যা সম্পর্কে চালকের ধারণা থাকা উচিত। এধরণের সমস্যার কারণে গাড়ির মাইলেজ কমে যাওয়া, মিসফায়ার, এক্সহস্ট থেকে কালো ধোঁয়া, ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। ফুয়েল পাম্প ও ইনজেক্টর নিয়মিত পরিষ্কার এবং ভালো মানের ফুয়েল ব্যবহার করলে দীর্ঘমেয়াদে এসব সমস্যা কমে।

(৮) এক্সহস্ট সিস্টেম

এক্সহস্ট সিস্টেম মূলত ইঞ্জিন থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া ও গ্যাস নির্গত করে। এছাড়াও এটি গাড়ির শব্দ নিয়ন্ত্রণ করে ও পরিবেশবান্ধব করে তোলে। এক্সহস্ট সিস্টেমের সাধারণ সমস্যা গুলো হলো – পাইপ এবং সাইলেন্সারে ফাটল বা জং ধরে ফুটো হয়ে যাওয়া, ক্যাটালিটিক কনভার্টার নষ্ট হয়ে যাওয়া, মাফলার ক্ষয় হওয়া, এক্সহস্ট ম্যানিফোল্ড ক্র্যাক হওয়া, এক্সহস্ট হ্যাঙ্গার ভেঙে যাওয়া, ইত্যাদি।

(৯) চাকা ও টায়ার

গাড়ির চাকা ও টায়ার পুরো গাড়ির ভর বহন করে। এখানে কোনো সমস্যা থাকলে গাড়ির নিরাপত্তা, পারফরম্যান্স এবং আরামদায়ক চালনায় প্রভাব পরবে। টায়ারের ট্রেড ক্ষয় হয়ে যাওয়া, সঠিক প্রেশার, গ্রিপ, হুইল অ্যালাইনমেন্ট এবং ব্যালেন্সিং সমস্যা, ড্যামেজড রিম, ইত্যাদি বিষয়ে চালকের নজর রাখা জরুরি। এসব সমস্যার কারণে গাড়ির কন্ট্রোল হারানোর সম্ভাবনা থাকে।

(১০) হেডলাইট, টেইললাইট ও টার্ন সিগন্যাল

গাড়ির হেডলাইট, টেইললাইট ও টার্ন সিগন্যাল রাতের বেলা ড্রাইভিং, দিক নির্দেশনা, এবং সংকেত আদান প্রদানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ওয়্যারিং সমস্যার কারণে গাড়ির লাইটিং সিস্টেমে সমস্যা হয়। এছাড়াও বাল্ব পুড়ে যাওয়া, ফিউজ পুড়ে যাওয়া, সুইচ নষ্ট হওয়া, পানি ঢুকে সার্কিট সমস্যা, কানেকশন লুজ হওয়া, ইত্যাদি সাধারণ সমস্যা হতে পারে। কিছুদিন পরপর বাল্ব ও কানেকশন পরীক্ষা করলে, এসব সমস্যা এড়ানো সম্ভব।

চালকদের আরো কিছু সাধারণ গাড়ির পার্টস সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত –

(১) অল্টারনেটর ব্যাটারি চার্জ এবং ইলেকট্রিক সিস্টেম সচল রাখে।

(২) রেডিয়েটর ইঞ্জিন ঠাণ্ডা রাখতে সাহায্য করে এবং ওভারহিটিং রোধ করে।

(৩) এয়ার ফিল্টার বাতাস পরিশোধন করে।

(৪) ড্যাশবোর্ড এবং গেজের মাধ্যমে গাড়ির স্পিড, তেল, ব্যাটারির চার্জ ইত্যাদি মনিটর করা যায়।

(৫) বাম্পার গাড়ির সামনের ও পেছনের অংশকে সুরক্ষিত রাখে।

(৬) এয়ারব্যাগ এবং সিট বেল্ট সংঘর্ষের সময় যাত্রীদের সুরক্ষা প্রদান করে।

(৭) এন্টি-লক ব্রেকিং সিস্টেম গাড়ির নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সহায়তা করে।

পরিশেষে, গাড়ির এই গুরুত্বপূর্ণ পার্টস সম্পর্কে বেসিক ধারণা থাকলে চালক যেকোনো সংকটে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন এবং নিরাপদ ড্রাইভ নিশ্চিত করতে পারবেন। এতে শুধু সময়ই বাঁচবে না, কমবে অপ্রত্যাশিত খরচও।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

(১) একজন চালকের গুরুত্বপূর্ণ গাড়ির পার্টস সম্পর্কে জানা কেন জরুরি?

গাড়ির বিভিন্ন অংশের কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকলে তৎক্ষণাৎ রিপেয়ার সহ যেকোনো পরিস্থিতি সামলানো সহজ হয়। এছাড়াও গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ এবং লং লাস্টিং পারফরম্যান্স পেতে গাড়ির পার্টস সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা থাকা জরুরি।

(২) গাড়ির কোন পার্টসগুলো সবচেয়ে বেশি রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন হয়?

ইঞ্জিন, ব্রেক, ব্যাটারি, টায়ার ও ক্লাচ সাধারণত বেশি রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন হয়।

(৩) গুরুত্বপূর্ণ পার্টসগুলোর সমস্যার লক্ষণ না বুঝলে কী ধরণের সমস্যা হতে পারে?

গাড়ি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়তে পারে, এবং বড় ধরনের খরচসাপেক্ষ ক্ষতি হতে পারে।

(৪) গাড়ির পার্টস সম্পর্কে ধারণা পাবার সবচেয়ে সহজ উপায় কী?

গাড়ির ম্যানুয়াল ভালোভাবে পড়া, ইউটিউব ভিডিও দেখা, এবং কিছু বিষয়ে অভিজ্ঞ মেকানিকের কাছে হাতে-কলমে শেখা।

(৫) গাড়ির কোন পার্টগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত?

ইঞ্জিন অয়েল, কুল্যান্ট, ব্রেক ফ্লুইড, টায়ার প্রেসার ও ব্যাটারির অবস্থা।

Facebook Comments
সাবস্ক্রাইব করুন

No spam guarantee.

Show More

Related Articles

Back to top button
Close
Close