বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হোন্ডা ব্যবহার এবং রক্ষণাবেক্ষণের উপযোগীতা
২০০০ সালের গ্রীষ্মে আমার বাবা ঠিক করেছিলেন একটি ব্যবহৃত সেকেণ্ড হ্যাণ্ড গাড়ি কিনবেন। কোন সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই তিনি পছন্দ করে বসলেন ৯০ দশকের হোন্ডা ব্র্যান্ডের একটি গাড়ি। আরও বিস্তারিত বলতে গেলে গাড়িটি কারব্যুরেটর সংযোজিত ১.৮ লিটারের চারটি সিলিণ্ডার সমৃদ্ধ অ্যাকর্ড। গাড়িটির এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো ৯০ দশকের বিলাসবহুল থ্রী বক্স এন্ট্রি লেভেল সেডানেও নেই। গাড়িটিতে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় ক্লাইমেট কন্ট্রোল, স্টিয়ারিং মাউন্টেড ক্রূজ কন্ট্রোল, একটি সিডি প্লেয়ার এবং এমন সব অন্যান্য গুণাগুণ যেগুলো এই জাতীয় জাপানী ব্র্যান্ডের গাড়িগুলোতেও পাওয়া যাবে না।
আমরা পুরো পাঁচ বছর সেই সিবি৭ অ্যাকর্ডটি ব্যবহার করেছিলাম এবং সেই পাঁচ বছরে হাতে গোনা যে অল্প কিছু সমস্যা আমরা পেয়েছিলাম সেগুলো হল – বামদিকের জানালার ভেঙ্গে যাওয়া মোটর, ত্রুটিপূর্ণ সেন্ট্রাল লকিং সিস্টেম এবং ছিদ্রযুক্ত রেডিয়েটর। গাড়ির আগের ব্যবহারকারী এই ত্রুটিপূর্ণ জিনিসগুলো নতুন করে প্রতিস্থাপন না করে নামেমাত্র মেরামত করেছিলেন। এরপর আমার ভাই গাড়িটিকে সহ্য ক্ষমতার বাইরে চালিয়ে দু’বার ওভারহিট করে ফেলে। একটি দশ বছরের পুরনো সেডানের ইঞ্জিনের পক্ষেই এমন চাপ সহ্য করা সম্ভব। সেই পাঁচ বছরে শুধুমাত্র ব্র্যান্ড নিউ রেডিয়েটর রিফিল করার সময়গুলোতে আমাদের গাড়ির সামনের ইঞ্জিনের ঢাকনাটি খুলতে হয়েছিল এবং গাড়িটি ব্যবহারের আড়াই বছরের মাথায় টায়ার বদলানোর সময় গাড়িটি জ্যাকে উঠাতে হয়েছিল। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে আমরা থ্রী বক্স সমৃদ্ধ অ্যাকর্ডটি বেশ স্বাচ্ছন্দে ব্যবহার করেছি। গাড়িটির ভেতরের “গ্লাসহাউস” ধরণের পরিবেশটা ছিল চমৎকার। গাড়িটির শকস কখনও বদলাতে হয়নি, রেডিয়েটর ছাড়া কোন পার্টসও কখনও বদলাতে হয়নি। বলতে গেলে গাড়িটি নিয়ে আমরা কোন রকমের সমস্যায়ই পরিনি।
কয়েক বছর পর, আমরা আরেকটি হোন্ডা কিনেছিলাম। এবারের গাড়িটি ছিল ১৯৯২ সিবি৫ ইন্সপায়ার – ২.৫ লিটারের স্ট্রেইট ফাইভ মোটর, ৫ স্পীড ম্যানুয়াল গিয়ারবক্স, কাঠের প্যানেলিং এবং অসাধারণ শৈল্পিক আকৃতিসম্পন্ন। তবে অনেকগুলো কারণে সিবি৫ ইন্সপায়ার ছিল বিশ্বব্যাপী একটি ফ্লপ মডেল। ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে গাড়িটির স্ট্রেইট লে আউট ইঞ্জিন এবং ট্রান্সভার্স ফ্রন্ট-হুইল-ড্রাইভ গিয়ারবক্স ছিল অনেক জটিল। রেগুলার অ্যাকর্ড গাড়ির পার্টসের সাথে এই মডেলটির পার্টসগুলোর তেমন কোন মিল ছিল না বলে গাড়িটির পার্টস খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর একটি ব্যাপার। তাছাড়াও গাড়িটি মাত্রাতিরিক্ত ফুয়েল খরচ করত। গাড়ির হুইল বেয়ারিং গুলো এতটাই দুর্বল ছিল যে একটি স্পীড ব্রেকারের ওপর দিয়ে জোরে চালালে সেগুলো সহজেই ভেঙ্গে যাবে। আমি কিভাবে বুঝলাম? আমার ছোট ভাই নিজেই এই কাজটি করেছে। একটি বড় স্পীড ব্রেকারের ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ৭০ কি.মি. বেগে চালানোর সময় আমাদের গাড়ির সামনের বাম চাকাটি খুলে বামে চলে গিয়েছিল আর ডান পাশের চাকাটি চলছিল সামনের দিকে। গাড়িটির বামদিকের ভাঙা হুইল বেয়ারিংটি নিয়ে আমাদের রাস্তায় থেমে যেতে হয়েছিল। আমরা সব হোন্ডা পার্টস ডিলারদের একের পর এক ফোন করে যাচ্ছিলাম। পাঁচবার চেষ্টা করার পর অবশেষে নিকুঞ্জে একটি দোকান পেলাম যাদের স্টকে হুইল বেয়ারিং ছিল। তারা একটি হুইল বেয়ারিং -এর দাম চেয়েছিল ২২,০০০ টাকা। রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যয়বহুল একটি ১৯৯৩ টয়োটা ভিস্তার এক জোড়া বেয়ারিং লাগাতে যেখানে আমার লেগেছিল মাত্র ১২,০০০ টাকা সেখানে হোন্ডা ব্র্যান্ডের এই গাড়িটির বেয়ারিং -এর জন্য আমাদের গুনতে হয়েছিল প্রায় চার গুণ বেশি টাকা। এই ঘটনাটি দিয়েই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি টয়োটা আর একটি হোন্ডা রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে খুব স্পষ্ট একটি তুলনামূলক ধারণা পাওয়া যায়। তাই না?
২০১০ সালে আমার একজন বন্ধু ঠিক করেছিল হোন্ডার অনুমোদিত ডিলার – ডিএইচএস মোটরস থেকে একটি ব্র্যান্ড নিউ এফডি সিভিক কিনবে। আমার বন্ধুটির পছন্দের তালিকায় ছিল একটি সিভিক এবং একটি প্রিমিও। কিন্তু আমার উপদেশমত বন্ধুটি তখনকার গাড়ির বাজারের ব্যতিক্রমধর্মী এবং আকারে তুলনামূলক বড় একটি সিভিক বেছে নিল। পাঁচ বছরের ব্যবহারিক জীবনে একবার ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত সেই দুর্দান্ত সিভিকটি তাদেরকে দিয়ে আসছে অবিরাম সার্ভিস। আমার বন্ধু এবং তার পরিবারের ভ্রমণধর্মী লাইফস্টাইলের সাথে মানিয়ে নেয়া সিভিকটি ছিল তাদের পথচলার বিশ্বস্ত সঙ্গী। সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় গাড়িটির ছাদ আঘাত পেয়ে খুলে গিয়েছিল, বাঁচিয়ে দিয়েছিল আমার সেই বন্ধু এবং আরও কয়েকজন সহযাত্রীকে। জাপান থেকে আমদানিকৃত আসল পার্টস দিয়ে গাড়িটিকে মেরামত করে আবার আগের চেহারায় ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। অনেকেই বলে থাকে যে বাংলাদেশে হোন্ডা রক্ষণাবেক্ষণ করা একেবারেই দুঃসাধ্য। কিন্তু আমার বন্ধুকে গাড়িটির পার্টস খুঁজে পেতে এবং পার্টসের খরচ পোষাতে খুব বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়নি। দুর্ঘটনায় খুলে যাওয়া গাড়ির ছাদ এবং সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া গাড়ির চেহারা একটি নামকরা ওয়ার্কশপে প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে একেবারেই নতুনের মত ঠিক করানোর পর কোন রকম মেকানিক্যাল সমস্যা ছাড়াই একনাগাড়ে তিন বছর পর্যন্ত সার্ভিস দিয়েছিল সেই গাড়িটি। হোন্ডার এই অসাধারণ পারফরম্যান্সে আমার বন্ধু এতটাই মুগ্ধ হয়েছিল যে পরবর্তীতে সে ২০১৪ ভেজেল মডেলের আরও একটি হোন্ডা কিনে নেয়। এই দুটি মডেলের হোন্ডা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পার্টস, যেমন, অয়েল ফিল্টার, এয়ার ফিল্টার, প্লাগ এবং সাধারণ সার্ভিসিং খরচ প্রায় টয়োটার মতই সস্তা। হোন্ডার রিপ্লেসমেন্ট পার্টসের খরচও টয়োটার তুলনায় সামান্য কিছু বেশি কারণ বাজারে হোন্ডার পার্টসের কোন রেপ্লিকা নেই এবং টয়োটার পার্টসের অসংখ্য চাইনিজ, তাইওানিজ, থাই এবং জাপানি রেপ্লিকা রয়েছে। একারণেই বাজারে টয়োটা এবং হোন্ডার পার্টসের দামে কিছুটা তারতম্য লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশে হোন্ডা ব্যবহার এবং সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার মূল নীতি হল – সঠিক মডেলটি বেছে নেয়া, ফ্লপ মডেলগুলো এড়িয়ে চলা, রিপ্লেসমেন্ট পার্টস কেনার সময় কোন রকম কার্পণ্য না করা এবং গাড়িটিকে ভালবেসে ব্যবহার করা। হোন্ডার রিপ্লেসমেন্ট পার্টস সম্পর্কে যা বলা হয় তা আসলেই সত্যি, একটি অরিজিনাল নষ্ট পার্ট একটি অরিজিনাল নতুন পার্ট দিয়ে রিপ্লেস করুন, রিপ্লেসমেন্টটি আপনাকে আজীবন সার্ভিস দেবে। যারা টয়োটা ব্যবহার করেন তারা তাদের টয়োটা রিপ্লেসমেন্ট পার্টস ব্যবহারের অভিজ্ঞতা থেকে এই পার্থক্যের ব্যাপারটি খুব ভাল ভাবে বুঝতে পারবেন। হোন্ডার পার্টসের দাম হয়ত টয়োটার পার্টসের দামের চেয়ে ২০-৩০% বেশি, কিন্তু হোন্ডার পার্টস আপনাকে প্রায় আজীবন সার্ভিস দেয়ার ক্ষমতা রাখে।
বর্তমানে আমাদের একটি ২০০৪ সিভিক মডেলের গাড়ি রয়েছে। গাড়িটি আমরা অত্যন্ত যত্নের সাথে ব্যবহার করি। যখনই গাড়িটির কোন রকম সমস্যা দেখা দেয় আমরা সাথে সাথেই গাড়িটি পরীক্ষা করে দেখে নেই। যদি কোন পার্টস পরিবর্তন করার প্রয়োজন পরে তবে আমরা হোন্ডার প্রশিক্ষিত মেকানিকদের দিয়ে নতুন এবং আসল পার্টস সংযোজন করিয়ে নেই। বাংলাদেশে একটি হোন্ডা ব্যবহার এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এতটুকু প্রচেষ্টাই যথেষ্ট।