যানবাহন

বাংলাদেশে গাড়ির বাজার – তথ্য ও উপাত্ত ২০২৫

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নগরায়ণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা দেশের গাড়ির চাহিদা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের গাড়ির বাজার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০২৪-২০২৫ সালের বাজারের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ক্রেতাদের চাহিদা, বিজ্ঞাপন প্রবণতা, এবং মূল্যসীমা অনুযায়ী গাড়ির বাজারের এক ভিন্ন চিত্র ফুটে উঠেছে। নতুন ও রিকন্ডিশন্ড গাড়ির চাহিদা, মধ্যম আয়ের ক্রেতাদের প্রভাব, এবং শহরভিত্তিক বিক্রয় প্রবণতা গাড়ির বাজারকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। ২০২৫ সালে গাড়ির বাজারের কী সম্ভাবনা রয়েছে এবং কীভাবে এটি আরও সম্প্রসারিত হতে পারে, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

বাংলাদেশে জনপ্রিয় গাড়ির ব্র্যান্ড ও মডেল

বাংলাদেশে সেরা গাড়ির মডেল

বাংলাদেশের গাড়ির বাজারে টয়োটা, নিশান, হোন্ডা ইত্যাদি ব্র্যান্ডগুলি জনপ্রিয়। ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গাড়ির বাজারে বরাবরের মতোই টয়োটা শীর্ষস্থানে রয়েছে, যা Bikroy এর বিজ্ঞাপনের ৮৬% দখল করে রেখেছে। টেকসই গাড়ি, সহজ রক্ষণাবেক্ষণ এবং চমৎকার রিসেল ভ্যালুর কারণে ব্র্যান্ডটি শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। হোন্ডা এবং নিসান যথাক্রমে ৫% ও ৩% বিজ্ঞাপনী অংশীদারিত্ব অর্জন করেছে। মিতসুবিশি ও হুন্ডাইয়ের বিজ্ঞাপন শেয়ার সমানভাবে ১% করে, আর অন্যান্য ব্র্যান্ডগুলো বাকি ৪% শেয়ার দখল করে রেখেছে। Honda, Nissan, এবং Mitsubishi-এর জনপ্রিয়তাও ধীরে ধীরে বাড়ছে। Honda, Nissan এবং Mitsubishi-এর গাড়িগুলোর চাহিদা থাকলেও, Toyota ব্র্যান্ডের আধিপত্য এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে।

বাংলাদেশে কোন শহরগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি গাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপন পোস্ট করা হয়?

শহরভিত্তিক গাড়ির বিজ্ঞাপন পোস্টিং

বিপুল সংখ্যক জনবলের প্রভাবে গাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপনে শীর্ষস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা, যা বাজারের ৬২% বিজ্ঞাপন দখল করে রেখেছে। পরবর্তীতে আছে খুলনা ২২% এবং চট্টগ্রাম ১২%। পাশাপাশি সিলেট ও রংপুরে ১% করে বিজ্ঞাপন Bikroy-এর তালিকায় দেখা যায়। আর অন্যান্য শহরগুলোর অংশ ৩%। এই তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, রাজধানী ঢাকা গাড়ির বাজারে প্রধান ভূমিকা পালন করছে, কারণ এখানে গাড়ির চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি। ঢাকার উচ্চ ব্যবসায়িক কার্যক্রম, গ্রাহকদের গাড়ি কেনার সক্ষমতা এবং নগর জীবনের প্রয়োজনীয়তাগুলো রাজধানীকে গাড়ি বিক্রির মূল কেন্দ্র বানিয়েছে। খুলনাও গাড়ির বাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করেছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ব্যবহারকারীরা গাড়ি কেনার জন্য সাধারণত কত ব্যয় করে থাকেন?

বাংলাদেশে গাড়ির বাজেট রেঞ্জ

বাংলাদেশের গাড়ির বাজারের বড় একটি অংশ মধ্যম আয়ের মানুষদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। Bikroy-এর ২৬% বিজ্ঞাপনেই গাড়ির মূল্য ২০-৩০ লক্ষ টাকার মধ্যে, যা গ্রাহকদের প্রধান চাহিদার অংশ হিসাবে দাঁড়িয়েছে। এরপর আছে ৩০-৪০ লক্ষ টাকা দামের গাড়ি, যা ২৫% বিজ্ঞাপন শেয়ার ধারণ করে এবং ৪০ লক্ষ টাকার ওপরে দামের গাড়িগুলোর বিজ্ঞাপন শেয়ার ২৪%। ১০-২০ লক্ষ টাকার মধ্যে দাম নির্ধারণ করা গাড়ির বিজ্ঞাপন শেয়ার ১৭%, এবং ৫-১০ লক্ষ টাকা মূল্যের গাড়িগুলোর শেয়ার ৬%। ৫ লক্ষ টাকার নিচে দাম নির্ধারণ করা গাড়ি, যা মূলত ৯০-এর দশকের কিংবা ২০০০ সালের প্রথম দিকের পুরাতন মডেলের গাড়িগুলো যেমন টয়োটা ওয়াগন, সুজুকি মাইক্রোবাস, টয়োটা করোলা এস, সুজুকি অল্টো। Bikroy এর বাজারে মাত্র ২% জায়গা দখল করে আছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে গাড়ির নিবন্ধন ১৪.৭% কমে ৩.০৮ লাখে নেমে এসেছে, যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২২ সালের তুলনায় এটি ৪৭% কম। এই পতনের প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে অর্থনীতিতে গতিমন্থরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, এবং ঋণের সুদহার বৃদ্ধি।

নতুন ও রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানি ও বিক্রির পরিসংখ্যান

বাংলাদেশে রিকন্ডিশন্ড বনাম নতুন গাড়ি

অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের গাড়ির বাজারে রিকন্ডিশন গাড়ির আধিপত্য ছিল এবং তা এখনও আছে বলা যায়। নতুন গাড়ির চাহিদা ক্রমশ বাড়লেও এটি মূলত উচ্চ আয়ের ক্রেতাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। Bikroy-এর তথ্য অনুযায়ী, প্ল্যাটফর্মের ৫৯% গাড়ির বিজ্ঞাপন রিকন্ডিশনড গাড়ির। এসব গাড়ি সাধারণত কয়েক বছর বিদেশে চালানোর পর আমদানি করা হয় এবং নতুনের মতো ঝকঝকে করতে পুনঃসংস্কার করা হয়। নতুন গাড়ির তুলনায় সাশ্রয়ী মূল্যে এগুলো বেশ ভালো বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয় বিধায় অধিকাংশ গ্রাহক ব্র্যান্ড নিউ গাড়ির বদলে এই রিকন্ডিশনড গাড়ির প্রতিই বেশি আগ্রহ দেখায়। 

ব্যবহৃত গাড়ি তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে, যা মোট বিজ্ঞাপনের ৪০%। এসব গাড়ি আগেই ব্যবহার করা হয়েছে এবং বর্তমান অবস্থার উপর ভিত্তি করে বিক্রি হয়, যা বাজারে সবচেয়ে বাজেট-বান্ধব বিকল্প। আর নতুন গাড়ির বিজ্ঞাপন মাত্র ১%, যা মূলত অনুমোদিত গাড়ি বিক্রেতাদের কাছ থেকে আসে। নতুন গাড়ির দাম বাংলাদেশের সিংহভাগ গ্রাহকের ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে হওয়ায়, এর চাহিদা তুলনামূলক অনেক কম।

তবে ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ডলার সংকটের কারণে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানি তিন-চতুর্থাংশ কমে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে যেখানে গড়ে ১১,০০০ রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি হতো, সেখানে এই সময়ে মাত্র ২,৮০০টি গাড়ি আমদানি হয়েছে। অন্যদিকে, নতুন গাড়ির আমদানি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল, তবে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে গাড়ির বাজারে বিক্রয়ে কিছুটা প্রভাব পড়েছে।

Bikroy-এ তালিকাভুক্ত গাড়ির ধরন

Bikroy-এ গাড়ির ধরন বিশ্লেষণ

Bikroy-এ তালিকাভুক্ত গাড়ির মধ্যে সেডান বা স্যালুন কার রয়েছে শীর্ষে, যা মোট বিজ্ঞাপনের ৩৬% অংশ দখল করে আছে। চমৎকারভাবে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও ছোট পরিবারের জন্য উপযোগী হওয়ায় এগুলো ব্যক্তিগত ক্রেতাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। এসইউভি ২০% বিজ্ঞাপনের শেয়ার ধারণ করেছে, এবং মাল্টি পারপাস ভেহিকল (এমপিভি) ১৯% বিজ্ঞাপন দখল করে। আর অন্যান্য গাড়ির ধরন মোট বিজ্ঞাপনের ১৮%। বৃহত্তর পরিবার এবং বিভিন্ন ভূখণ্ডে চলার উপযোগী হওয়ায় এসইউভি ও এমপিভিগুলো পারিবারিক ভ্রমণ ও অ্যাডভেঞ্চারের জন্য আদর্শ। হ্যাচব্যাক গাড়ি তালিকার ৭% শেয়ার ধারণ করে, যা শহরের রাস্তায় চলাচলের জন্য কমপ্যাক্ট ও কার্যকর বিকল্প সরবরাহ করে।

২০২৫ সালে গাড়ির বাজারের সম্ভাবনা ও পূর্বাভাস

বাংলাদেশের গাড়ির বাজারে নতুন ব্র্যান্ডের প্রবেশ এবং ইলেকট্রিক গাড়ির উত্থান উল্লেখযোগ্য। ২০২৫ সালে গাড়ির বাজার আরও সম্প্রসারিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলেকট্রিক গাড়ির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে এবং সরকারের নীতিমালা এই পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। জ্বালানির দাম এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা গাড়ির বাজারের ভবিষ্যত নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হবে। মধ্যম আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার ফলে ২০-৪০ লক্ষ টাকার গাড়ির বিক্রি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। পাশাপাশি, Toyota-এর আধিপত্য বজায় থাকবে বলে অনুমান করা যাচ্ছে, তবে অন্যান্য ব্র্যান্ডগুলোর প্রতিযোগিতাও বাড়বে। পাশাপাশি, নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি বাজারে প্রবেশ করলে প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে এবং ক্রেতাদের জন্য বিকল্পের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

সর্বশেষে, বাংলাদেশের গাড়ির বাজার ২০২৫ সালে আরও গতিশীল হবে এবং নতুন প্রযুক্তি ও বাজার প্রবণতা গাড়ি বিক্রয় ও কেনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

১. বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় গাড়ির ব্র্যান্ড কোনটি?

বাংলাদেশের গাড়ির বাজারে Toyota এখনো শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। এছাড়াও Honda, Nissan, এবং Mitsubishi-এর জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়ছে।

২. বাংলাদেশের কোন শহরগুলোতে গাড়ির চাহিদা সবচেয়ে বেশি?

ঢাকা, খুলনাসহ চট্টগ্রাম ও সিলেটে গাড়ির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। 

৩. বাংলাদেশে নতুন ও রিকন্ডিশন্ড গাড়ির মধ্যে কোনটি বেশি জনপ্রিয়?

বর্তমানে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির জনপ্রিয়তা বেশি থাকলেও, ডলার সংকটের কারণে ২০২৪ সালে এর আমদানি প্রায় ৭৫% কমে গেছে। নতুন গাড়ির আমদানি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকলেও, উচ্চমূল্য এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে অনেক ক্রেতা এখন ব্যবহৃত গাড়ির দিকে ঝুঁকছেন।

৪. গাড়ির দাম বাড়ার সম্ভাবনা আছে কি?

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ডলারের বিনিময় হার এবং আমদানি শুল্কের পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে গাড়ির দাম বাড়তে বা কমতে পারে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে গাড়ির দাম বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা আমদানির উচ্চ ব্যয় এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে হতে পারে।

৫. ২০২৫ সালে ইলেকট্রিক গাড়ির চাহিদা কেমন হবে?

২০২৫ সালে বাংলাদেশে ইলেকট্রিক গাড়ির (EV) চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জ্বালানির উচ্চমূল্য, পরিবেশবান্ধব যানবাহনের প্রতি আগ্রহ, এবং সরকারের সহায়ক নীতিমালার ফলে অনেক ক্রেতাই EV-র দিকে ঝুঁকছেন। শহরভিত্তিক ব্যবহার, চার্জিং স্টেশন অবকাঠামোর উন্নয়ন, ও দীর্ঘমেয়াদী সাশ্রয় সুবিধা এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করবে।

Facebook Comments
সাবস্ক্রাইব করুন

No spam guarantee.

Show More

Related Articles

Back to top button
Close
Close