বাংলাদেশের প্রপার্টি মার্কেট ২০২৫ঃ সামগ্রিক চিত্র ও সাম্প্রতিক প্রবণতা

বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট খাত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ণ, এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন এই খাতের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা অঞ্চলে আবাসন ও বাণিজ্যিক সম্পত্তির চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ক্রেতার পছন্দের পরিবর্তন, প্রযুক্তিনির্ভর লেনদেন এবং সরকারি আবাসন প্রকল্প ও নীতিমালার মাধ্যমে বাজারে নতুনত্ব আসছে। যদিও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, নির্মাণ ব্যয় ও ঋণের উচ্চ সুদের মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে এই খাতের দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা এখনও দৃঢ়।
বাংলাদেশের প্রপার্টি মার্কেটের মূল দিকনির্দেশনা
১. ঢাকা শহরে প্রপার্টি বিক্রয়ে মিরপুর সবচেয়ে জনপ্রিয় এলাকা
সাশ্রয়ী মূল্য, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং মেট্রোরেলের সংযোগের জন্য মিরপুর হটস্পট হয়ে উঠেছে। মেট্রোরেল লাইন-৬-এর সংযোগ এই এলাকার গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। গুলশান, বনানী কিংবা ধানমণ্ডির তুলনায় মিরপুর মধ্যবিত্তদের জন্য অনেক বেশি বাজেটবান্ধব।
২. ব্যবহৃত ফ্ল্যাট বিক্রির প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে
উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির কারণে নতুন ফ্ল্যাটের পরিবর্তে পুরনো ফ্ল্যাট ক্রয়ের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। এসব ফ্ল্যাটে সাধারণত ভালো অবস্থান এবং বিদ্যমান অবকাঠামো পাওয়া যায়। ফলে সেকেন্ডারি মার্কেট আরও সক্রিয় হচ্ছে এবং ফ্ল্যাট ফ্লিপিং জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
৩. চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাঃ
বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট বাজারের সম্ভাবনা ব্যাপক হলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। যেমনঃ
- উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ঋণের উচ্চ সুদের হারঃ অনেকেই নতুন সম্পত্তি কেনার পরিকল্পনা পিছিয়ে দিচ্ছেন।
- জমির উচ্চমূল্য ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের সীমিত বিকল্পঃ নতুন আবাসিক প্রকল্পের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।
- আইনগত জটিলতাঃ অনেক ক্ষেত্রেই জমির মালিকানা ও রেজিস্ট্রেশনে জটিলতা দেখা দেয়।
বাংলাদেশ রিয়েল এস্টেট মার্কেটের কিছু সম্ভাবনা এখানে তুলে ধরা হলোঃ
- স্মার্ট সিটি প্রকল্প ও সরকারি সহায়তাঃ আধুনিক নগর পরিকল্পনা, ডিজিটাল অবকাঠামো ও পরিবেশবান্ধব সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকার স্মার্ট সিটি প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।
- সাশ্রয়ী আবাসনের চাহিদা বৃদ্ধিঃ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের আবাসন চাহিদা মেটাতে কম দামে মানসম্পন্ন ফ্ল্যাট ও হাউজিং প্রকল্পের গুরুত্ব বাড়ছে।
- বিদেশি বিনিয়োগ ও ফাইন্যান্সিং বিকল্পঃ বৈদেশিক বিনিয়োগ ও সহজতর ঋণ প্রাপ্তির সুযোগে রিয়েল এস্টেট খাতে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজ হচ্ছে।
ঢাকায় প্রপার্টি বিক্রির জন্য সেরা লোকেশন

ঢাকার প্রপার্টি মার্কেটে মিরপুর বর্তমানে সবচেয়ে সক্রিয় ও জনপ্রিয় বিক্রয় এলাকা হিসেবে শীর্ষে রয়েছে, যেখানে মোট বিক্রয়ের ৩২% অংশ রয়েছে। মেট্রোরেলের সংযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সাশ্রয়ী দামের কারণে এটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, যা ১৯% শেয়ার নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে, আধুনিক পরিকল্পনা ও উচ্চমানের নাগরিক সুবিধার জন্য উচ্চবিত্ত ও প্রবাসীদের কাছে জনপ্রিয়। মোহাম্মদপুর ৯% শেয়ার নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে, যেখানে ধানমণ্ডির নিকটতা এবং নতুন প্রকল্প বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও বাড্ডা (৭%) ও উত্তরা (৬%) ধীরে ধীরে আবাসন ও বাণিজ্যিকভাবে বিকশিত হচ্ছে। ঢাকার অন্যান্য এলাকায় মোট ২৬% বিক্রয় হচ্ছে, যা শহরের বাইরের এলাকাগুলোর প্রতিও ক্রেতাদের আগ্রহকে নির্দেশ করে।
ঢাকার বাইরে প্রপার্টি বিক্রির জন্য সেরা লোকেশন

ঢাকার বাইরের রিয়েল এস্টেট মার্কেটেও বেশ সক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। রংপুর ১৯% শেয়ার নিয়ে শীর্ষে রয়েছে, যেখানে উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নতুন প্রপার্টি কেনার আগ্রহ বাড়াচ্ছে। চট্টগ্রাম, দেশের প্রধান বাণিজ্যিক শহর, ১৪% শেয়ার নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে এবং আবাসিক ও বাণিজ্যিক উভয় ক্ষেত্রেই চাহিদা বাড়ছে। ঢাকার বাইরের ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন শহরতলি ১২% শেয়ার নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে, যেখানে শিল্পাঞ্চল ও নতুন আবাসন প্রকল্প বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিলেট (১০%) প্রবাসীদের জন্য প্রিয় এলাকা হিসেবে পরিচিত, আর খুলনা (৮%) মংলা বন্দর ও শিল্প উন্নয়নের কারণে ধীরে ধীরে বিনিয়োগকারীদের নজরে আসছে। অবশিষ্ট ৩১% বিক্রয় দেশের অন্যান্য অঞ্চলে হচ্ছে, যা সার্বিকভাবে দেশের রিয়েল এস্টেট আগ্রহের পরিধিকে আরও বিস্তৃত করে।
ঢাকার প্রপার্টি ভাড়ার ট্রেন্ড

ঢাকার ভাড়ার বাজারে গুলশান সবচেয়ে প্রভাবশালী, যেখানে মোট ভাড়ার ৭৭% তালিকা রয়েছে। এটি কূটনৈতিক এলাকা ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির ব্যবসায়িক কেন্দ্র হওয়ায় এ চাহিদা দেখা যায়। বনানী (৮%), বসুন্ধরা (৫%), বারিধারা (৩%) এবং উত্তরা (২%) কিছুটা কম অংশ নিয়ে তালিকায় থাকলেও অভিজাত জীবনযাত্রার কারণে জনপ্রিয়। অন্যদিকে, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও বনশ্রী এলাকার মতো মধ্যবিত্ত ও পেশাজীবী শ্রেণির মধ্যে জনপ্রিয়তা বাড়ছে। মেট্রোরেল, আইটি হাব ও কো-ওয়ার্কিং স্পেসের সম্প্রসারণের ফলে স্টুডিও ও শেয়ার্ড অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ঢাকার ভাড়ার বাজার দিন দিন আরও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠছে।
ঢাকার বাইরের প্রপার্টি ভাড়ার ট্রেন্ড

ঢাকার বাইরের ভাড়ার বাজারেও দ্রুত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সিলেট এখানে শীর্ষস্থানে রয়েছে, যেখানে ৪৩% তালিকা রয়েছে, যা মূলত প্রবাসীদের বিনিয়োগ ও আগ্রহের কারণে। চট্টগ্রাম ১৫% অংশ নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে, যেখানে প্রধান বাণিজ্যিক এলাকাগুলিতে ভাড়ার দাম অপেক্ষাকৃত বেশি। ঢাকা বিভাগের অন্যান্য শহরগুলো ১২% শেয়ার নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে। খুলনা (৮%) এবং রাজশাহী (৫%) শিল্প ও শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের কারণে ধীরে ধীরে ভাড়ার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়ন ও শহরায়নের ফলে এসব এলাকায় ভবিষ্যতে ভাড়ার বাজার আরও বিস্তৃত হবে।
ফ্ল্যাটের নির্মাণ অবস্থা অনুযায়ী প্রপার্টি বিক্রির বিশ্লেষণ

বর্তমানে বাজারে থাকা প্রপার্টির ৪৮% ফ্ল্যাট নির্মাণাধীন অবস্থায় রয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। প্রস্তুত ফ্ল্যাটের পরিমাণ ৪০%, যা তাৎক্ষণিক বসবাস বা ভাড়ার জন্য উপযুক্ত। ১০% ফ্ল্যাট প্রাথমিক উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি সুসংগঠিত পাইপলাইনের প্রতিফলন। বাকি ২% ফ্ল্যাট অনির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে পড়ে, যেখানে নতুনভাবে সম্পন্ন বা ব্যতিক্রমী প্রপার্টি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
ঢাকায় প্রপার্টি কেনার জন্য শীর্ষ সার্চ করা এলাকা

ঢাকার মধ্যে প্রপার্টি কেনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সার্চ করা এলাকা হচ্ছে বসুন্ধরা (২৫%) ও গুলশান (২০%)। আধুনিক অবকাঠামো ও উচ্চমানের নাগরিক সুবিধার জন্য এই এলাকাগুলো ক্রেতাদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। মিরপুর (১২%), মোহাম্মদপুর (১০%) ও পূর্বাচল (৪%) এলাকাগুলোতেও চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। বাকি ২৯% সার্চ ঢাকার অন্যান্য এলাকায় হচ্ছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে ক্রেতারা বৈচিত্র্যময় বিকল্প খুঁজছেন এবং শহরের নতুন ও উদীয়মান এলাকাগুলোর দিকেও দৃষ্টি দিচ্ছেন।
ঢাকার বাইরে প্রপার্টি কেনার জন্য শীর্ষ সার্চ করা এলাকা

ঢাকার বাইরেও প্রপার্টি কেনার আগ্রহ ব্যাপক। খুলনা (১৫%) ও সিলেট (১১%) এই তালিকায় শীর্ষে আছে, যেখানে প্রবাসী ও নতুন শিল্পাঞ্চলের প্রভাবে চাহিদা বেড়েছে। রাজশাহী (১০%) এবং চট্টগ্রাম (৮%) যথাক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ক্রেতাদের আকর্ষণ করছে। রংপুর ৬% সার্চ পেয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় অংশ, অর্থাৎ ৫০%, পড়েছে অন্যান্য ক্যাটাগরিতে, যা দেখায় যে অনেকেই ঢাকার বাইরের তুলনামূলক কম দামের ও শান্তিপূর্ণ এলাকায় প্রপার্টি কিনতে আগ্রহী।
মূল্য অনুযায়ী বিক্রির জন্য প্রপার্টি প্রাপ্যতা

ঢাকার প্রপার্টি বাজারে উচ্চমূল্যের প্রপার্টির আধিক্য লক্ষ্য করা যায়, যেখানে ৪২% প্রপার্টি ১১ হাজার টাকা বা তার বেশি প্রতি স্কয়ার ফুট মূল্যে তালিকাভুক্ত। মধ্যম দামের বিকল্প হিসেবে ৫-৭ হাজার (১৭%), ৭-৯ হাজার (১৬%) এবং ৯-১১ হাজার (১০%) টাকার প্রপার্টিও বিদ্যমান। তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী দামের, অর্থাৎ ৫ হাজার টাকার নিচে প্রতি স্কয়ার ফুট দামে, প্রপার্টি ১৫% রয়েছে। এই প্রবণতা দেখায় যে উচ্চমানের আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় প্রিমিয়াম প্রপার্টির চাহিদা বেশি।
মূল্য অনুযায়ী ভাড়ার জন্য প্রপার্টি প্রাপ্যতা

বর্তমানে ২২% ভাড়ার প্রপার্টি ২০০-৩০০ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ার মধ্যে রয়েছে, যা উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য উপযুক্ত। এছাড়াও ৮০-১০০ হাজার (১৫%) এবং ৬০-৮০ হাজার (১৪%) টাকার ভাড়ার সেগমেন্টগুলোতেও যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী ভাড়ার যেমন <২০ হাজার (৬%), ২০-৪০ হাজার (৪%) এবং ৪০-৬০ হাজার (৫%) ভাড়া করা প্রপার্টির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। ৪০০-৫০০ হাজার টাকার মতো উচ্চমূল্যের ভাড়া খুব কম, মাত্র ৪%। তবে অন্যান্য ক্যাটাগরিতে ৩১% তালিকা পড়ে, যা প্রপার্টির বৈচিত্র্য ও ভিন্ন ভিন্ন বাজেট অনুযায়ী অপশনের প্রাচুর্যকে নির্দেশ করে।
উপসংহার
২০২৫ সালে বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট খাত চ্যালেঞ্জের মধ্যেও একটি সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে রয়ে যাবে। সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, বিদেশি বিনিয়োগ, এবং প্রযুক্তির ব্যাবহার এই খাতকে আরও গতিশীল করে তুলবে। ভবিষ্যতে সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন, টেকসই অবকাঠামো, এবং আধুনিক শহর পরিকল্পনা বাংলাদেশে রিয়েল এস্টেট বাজারকে আরও শক্তিশালী করবে।