নবীন খামারিরা কীভাবে ছাগল লালনপালন করবেন? কিছু পরামর্শ
অনেকেই দুধ, পনির এবং মাংসের জন্য গৃহস্থালী পরিসরে বা ছোট পারিবারিক খামারে নিজ হাতে ছাগল লালনপালন করে থাকেন। এটি অবশ্য অর্থ উপার্জনেরও একটি মোক্ষম উপায়, কারণ দুধ, পনির এবং মাংস বিক্রি করে বেশ মুনাফাও করা যায়। খাদ্যের জন্য পশুপালন করতে চাইলে কীভাবে সেটি শুরু করবেন তা ভেবেচিন্তে ঠিক করাটাই কঠিন, তবে ছাগল পালন শুরু করতে চাইলে আপনার বড় কোনো পশুখামার তৈরীর প্রয়োজন হবে না।
প্রজাতি
আপনাকে প্রথমে আপনার চাহিদা ঠিক করে নিতে হবে। আপনি কি সৌখিন পোষাপ্রাণী হিসেবে ছাগল পুষে দুধ এবং পনিরের ঘরোয়া প্রয়োজন মেটাতে চান, নাকি মাংসের চাহিদা পূরণের জন্য ছাগল পালন করতে চান? এরকম ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজনের জন্য ছাগলের ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। দুধের জন্য রয়েছে স্যানিন (Saanen), লা-মাঞ্চা (La Mancha), নিউবাইন (Nubain) প্রজাতির ছাগল। মাংসের জন্য সেরা হলো স্পেনীয় কিকো (Kiko) প্রজাতির ছাগল।
ছাগল ক্রয়
আপনি কোন প্রজাতির ছাগল কিনবেন তা ঠিক করার পর আপনাকে ভাবতে হবে যে, আপনি কী ছাগলছানা বা ছাগলের বাচ্চা কিনবেন নাকি পূর্ণবয়স্ক ছাগল কিনবেন। আপনি যদি প্রজননের মাধ্যমে আপনার ছাগলের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে চান, তবে আপনার প্রয়োজন হবে একটি মাদি ছাগল যাকে বকরী বলা হয়। buck হলো পুরুষ ছাগল। ছাগলছানা আপনি বেশ সস্তায় কিনতে পারবেন, কিন্তু সেগুলোর আবার ঝামেলা আছে। ছাগলছানাগুলো কিছুটা নাজুক ধরনের হয় এবং নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে খানিকটা সময় নেয়। একারণে প্রথমদিকে সেগুলোর মেজাজ খিটখিটে থাকে। সেক্ষেত্রে আপনি সময় নিয়ে এদেরকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে পারেন এবং এদেরকে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারেন।
আবাসস্থল
ঠাণ্ডা থেকে এবং রোদের তাপ থেকে বাঁচাতে এগুলোরর জন্য ছাউনি দরকার হবে। এগুলো যখন বাইরে চরে বেড়ানোর মত মোটাতাজা প্রাণীতে পরিণত হবে তখন ক্ষতিকর জিনিস থেকে বাঁচতে এদের ছোটখাট হলেও একটি ছাউনি দরকার হবে। এদের আবাসস্থলের চারপাশে বেড়া দেয়ারও প্রয়োজন হবে। ছাগলকে যদি ঘের দিয়ে পরিবেষ্টিত না রাখা হয় তবে অনেক সময় এরা চরে বেড়াতে গিয়ে পথ ভুলে হারিয়ে যেতে পারে এবং শিকার প্রাণী পালের মধ্যে ঢুকে এদের অনেকগুলোকেই মেরে ফেলতে পারে। যে জায়গায় এদের আবাসস্থল তৈরী করা হবে সে জায়গায় খাদ্য এবং স্বাদু পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে। আমাদের আরও একটি প্রবন্ধ থেকে জেনে নিতে পারেন নবীন খামারিগণ কীভাবে হাঁসমুরগি লালন-পালন করবেন।
পরিসর
আপনার নতুন গাবাদিপশুর ছুটাছুটি করে বেড়ানো আর ঘাস খাওয়ার জন্য বিস্তৃত জায়গা থাকতে হবে। এদেরকে ছোট পরিসরের কোনো বদ্ধ জায়গায় রাখা চলবে না। এদের রাতের বেলার ঘুমানোর জায়গা যদি ছোট কোনো আবদ্ধ জায়গায় হয় তাতে অসুবিধা নেই কিন্তু দিনের বেলায় এরা যেন ছুটাছুটি করে বেড়াতে পারে সে ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। এরা তিড়িংবিড়িং লাফালাফি আর ছুটাছুটি করতে পছন্দ করে। আনন্দে থাকা ছাগলগুলো স্বাস্থ্যবান হয়ে থাকে এবং বেশি দুধ দেয়।
প্রতিপালন
এদেরকে শুধুই ঘাস খাইয়ে রাখা ঠিক হবে না। শুধু ঘাস দিয়ে এদের পুষ্টির অভাব পূরণ হবে না। সেইসঙ্গে এদেরকে খড় এবং ভূষি খাওয়াতে হবে। কোনো কোনো অঞ্চলে এদের স্বাভাবিক খাবারে নির্দিষ্ট কিছু খনিজ লবণ থাকে না, সেজন্য পশুচিকিৎসকের পরমর্শে পরিপূরক ঔষধ খাওয়াতে হবে। আপনি এদেরকে ট্যাবলেট গুঁড়া করে খাওয়াতে পারেন, তবে এদেরকে ঘাসপাতা খাওয়ানো বাদ দেবেন না। অর্থাৎ এদেরকে প্রচুর পরিমাণে সবুজ ঘাসপাতা খাওয়াবেন। গর্ভবতী বকরীর পুষ্টিগত চাহিদার দিকে বিশেষ নজর রাখবেন। এদের জন্য অধিক খাদ্য ও ভিটামিন প্রয়োজন হতে পারে।
স্বাস্থ্য
এরা দলবদ্ধ প্রাণী হওয়ায় আলাদাভাবে প্রতিটির যত্ন নেয়ার দরকার হয় না, তবে এদের যথাযথ দেখাশুনা করতে হয়। টিকাদান এবং কৃমিমুক্তির জন্য এদেরকে নিয়মিতভাবে পশুচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এরা প্রায়ই পরজীবি দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং পরজীবি দ্বারা আক্রান্ত হলে আপনাকে এদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। যদি পশুচিকিৎসকের কাছে যেতে না পারেন সেক্ষেত্রে আপনি নিজেই পশুকে টিকা দেয়ার পদ্ধতি শিখে নিতে পারেন। যাহোক, এদের কোনোটি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তবে সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য এদেরকে কোনো পশুচিকিৎসকের নিকট নিয়ে যেতেই হবে।
দুধ দোহন
দুধের জন্য ছাগল কিনতে চাইলে সেক্ষেত্রে আপনার দুধ দোহনের সরঞ্জাম এবং দুধ দোহনচক্র সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। বাচ্চা প্রসব করার পর থেকে নিয়ে ১০ মাস পর্যন্ত আপনি একটি মাদি ছাগল থেকে দুধ দোহন করতে পারবেন। এরপর তাকে বিশ্রাম দিতে হবে। মাদি ছাগলটির স্বাস্থ্যগত অবস্থার উপর বিশ্রামকালের মেয়াদ নির্ভর করে তবে বিশ্রামকাল কমপক্ষে দুই মাস রাখতেই হবে। নির্দিষ্ট কোনো মাদি ছাগলকে পুনরায় গর্ভবতী করিয়ে নেয়ার পূর্বে আপনাকে এর প্রজননচক্র এবং স্বাস্থ্যগত তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে। দুধ দোহনচক্র চলছে এমন কোনো বকরীকে দিনে দুইবার দোহন করা যায়। একটি বকরী থেকে দিনে প্রায় এক গ্যালন দুধ সংগ্রহ করা যায়।
গর্ভকরণ
আপনি যদি আপনার ছাগলপালের বংশবৃদ্ধি করতে চান তবে মাদি ছাগলের বিশ্রামকালীন সময়ে পুরুষ ছাগলকে এর সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে। দোহনচক্র ও গর্ভচক্রের মাঝামাঝি সময়ে প্রজননক্ষম হওয়ার জন্য মাদি ছাগলের বিশ্রাম দরকার। এটি এদের প্রজননস্বাস্থ্য এবং সার্বিক সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি বংশবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ছাগল পালন করতে চান তবে আপনাকে ছাগলপালের আকার সম্পর্কে ভেবে নিতে হবে। কিছু ছাগলছানা আপনি চাইলে বিক্রি করে দিতে পারেন, সেইসঙ্গে মাদিটিকেও বিক্রি করতে পারেন অথবা দুধের জন্য রেখে দিতে পারেন। এদেরকে আপনার উঠানের যত্রতত্র ছুটে বেড়াতে দেবেন না। এদের জন্য নির্দিষ্ট সুপরিসর জায়গা রাখতে হবে, কারণ গাদাগাদি করে রাখলে এরা পরজীবির আক্রমণ ও রোগবালাইয়ের শিকার হবে।
ছাগদুধের উপকারিতা
আজকাল লোকজন গরুর দুধের চাইতে ছাগদুধ বেশি পছন্দ করতে শুরু করেছে কারণ ছাগদুধে কম চর্বি রয়েছে। প্রতি আউন্স ছাগদুধে ক্যালরির পরিমাণও কিছু বেশি রয়েছে। এটি সহজপাচ্যও বটে এবং গরুর দুধে যাদের সমস্যা আছে তাদের জন্য এটি একটি ভাল বিকল্প হতে পারে। দুধ থেকে পনির, ছানা ইত্যাদির মতো অনেক ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরী হয়। অনেক খাবার রান্নায় এটিকে গরুর দুধের উত্তম বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। দুধ বিক্রি করার সময় দেখবেন আপনারই এলাকার অনেক পরিবার তা কিনতে চাইবে। মুনাফার জন্য ছাগদুধ বিক্রির অনেক উপায় রয়েছে।
সরঞ্জাম
প্রতিপালনের জন্য ছাগল কেনার সময় যেমন ভাল দেখে কিনবেন তেমনই দুধ দোহনের যন্ত্রপাতিও আপনাকে দেখেশুনে ভালটা কিনতে হবে। আপনার কোন ধরনের যন্ত্রপাতি দরকার তা নির্ভর করছে আপনার ছাগলপালের আকারের উপর এবং আপনি হাতে দুধ দোহন করবেন কি-না তার উপর। আপনার দরকার হবে সোয়া এক গ্যালন মাপের একটি স্টিলের বালতি । এটিতে করেই আপনাকে দুধ সংগ্রহ করতে হবে। বাঁট মোছার টিস্যু এবং দুধ ছাঁকার জন্য ছাঁকনি ও ফিল্টারও প্রয়োজন হবে। হাতে দোহন করতে হলে এ ক’টি জিনিসেই আপনার কাজ চলে যাবে। কিন্তু আপনি যদি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে দুধ দোহন করতে চান তবে আপনাকে একটি যন্ত্র কিনতে হবে যেটাতে একটি সংগ্রাহক নল ও দুধ নামানোর একটি চোষক রয়েছে।
ছাগলের প্রজাতি, পালের আকার এবং তা সৌখিন পোষাপ্রাণী হিসেবে পালন করা হবে কি না তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে ছাগলের মালিকের উপর। প্রতিটি মানুষই আলাদা। ছাগলপালনকে আপনি শুধুই অতিরিক্ত কিছু অর্থ উপার্জনের একটি আকর্ষণীয় উপায় না ভেবে এটিকে দুধ এবং মাংস যোগান দেয়ার প্রাথমিক পেশা হিসেবেও গ্রহণ করতে পারেন। ছাগল পালনের মাধ্যমে দুধ এবং খাদ্য উৎপাদন করে খামারের মালিক অর্থ উপার্জন করতে পারেন। প্রজননের মাধ্যমে ছাগলছানা উৎপাদন করেও অর্থ উপার্জন করা যায়। আপনি পোষাপ্রাণী ব্যবসায় উৎসাহী হলে আরও দেখে নিন কবুতর পালনের ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ।