গাড়ি কেনার আগে যে বিষয়গুলো অবশ্যই যাচাই করবেন

গাড়ি কেনা একটা বড় বিনিয়োগ – মূলধন বাজেটিং সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত। অনেকেই শুধুমাত্র বাহ্যিক ডিজাইন বা ব্র্যান্ডের ভিত্তিতে গাড়ি কিনে ফেলেন, কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যাচাই না করলে পরবর্তীতে বিপাকে পড়তে হতে পারে। তাই অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। আজকের এই গাইড থেকে জেনে নিন গাড়ি কেনার আগে কোন বিষয়গুলো অবশ্যই যাচাই করবেন।
১। বাজেট নির্ধারণ করুন
গাড়ি কেনার আগে প্রথমেই আপনাকে আপনার বাজেট নির্ধারণ করতে হবে। এটি নির্ভর করবে আপনার অর্থনৈতিক অবস্থার উপর এবং আপনি কেমন গাড়ি কিনতে চান তার উপর।
নতুন গাড়ি নাকি ব্যবহৃত গাড়ি?
নতুন গাড়ি সাধারণত বেশি নির্ভরযোগ্য এবং ওয়ারেন্টি সুবিধা থাকে, কিন্তু ব্যবহৃত গাড়ি কম খরচে পাওয়া যায়।
ক্যাশ নাকি লোন?
যদি আপনি ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনতে চান, তাহলে সুদের হার ও মাসিক কিস্তির হিসাব আগেই ভালোমতো বুঝে ও জেনে নিন।
টিপসঃ গাড়ির মূল দামের বাইরে বীমা, রেজিস্ট্রেশন ফি, রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানি খরচও বাজেটের মধ্যে রাখুন।
২। প্রয়োজন অনুযায়ী গাড়ির ধরণ বাছাই করুন
আপনার ব্যবহারের উপর নির্ভর করবে আপনি কোন ধরণের গাড়ি কিনবেন।
- সেডানঃ পারিবারিক ও ব্যাক্তিগত ব্যবহারের জন্য ভালো।
- এসইউভি (SUV)ঃ বেশি জায়গা ও অফ-রোড সুবিধা চাইলে এসইউভি উপযুক্ত।
- হ্যাচব্যাকঃ শহরের ট্রাফিকের জন্য উপযোগী ও জ্বালানি সাশ্রয়ী।
- পিকআপ বা ট্রাকঃ ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করা হয়।
টিপসঃ পরিবারের সদস্য সংখ্যা, দৈনিক যাতায়াতের দূরত্ব, রাস্তার অবস্থা ও গাড়ির পার্কিং ব্যবস্থা বিবেচনা করুন।
৩। গাড়ির অবস্থা পরীক্ষা করুন (ব্যবহৃত গাড়ির ক্ষেত্রে)
যদি আপনি ব্যবহৃত গাড়ি কিনতে চান, তবে নিচের বিষয়গুলো অবশ্যই পরীক্ষা করুনঃ
- ইঞ্জিন ও পারফরম্যান্সঃ ইঞ্জিনের শব্দ স্বাভাবিক কিনা এবং ঠিকমতো স্টার্ট হয় কিনা চেক করুন।
- মিটার রিডিংঃ গাড়ির মোট চালিত কিলোমিটার দেখে অনুমান করুন এটি কতটা ব্যবহার হয়েছে।
- বডি ও পেইন্টঃ গাড়ির বডিতে কোনো ডেন্ট বা স্ক্র্যাচ আছে কিনা দেখুন।
- টায়ারের অবস্থাঃ টায়ারের ঘর্ষণ পরীক্ষা করুন, খুব বেশি ক্ষয় হলে নতুন টায়ার কিনতে হতে পারে।
- ব্রেক ও সাসপেনশনঃ টেস্ট ড্রাইভের মাধ্যমে ব্রেক ও সাসপেনশনের কার্যকারিতা যাচাই করুন।
টিপসঃ অভিজ্ঞ একজন মেকানিক সঙ্গে নিয়ে গাড়ির চেকআপ করান।
৪। ফুয়েল ইকোনমি ও মাইলেজ যাচাই করুন
বাজারে বিভিন্ন মডেলের গাড়ির ফুয়েল ইকোনমি ভিন্ন হয়। আপনি যদি দীর্ঘ যাতায়াত করেন, তাহলে জ্বালানি সাশ্রয়ী গাড়ি বেছে নেওয়াই ভালো।
গড় মাইলেজ তুলনা (বাংলাদেশের জনপ্রিয় মডেল অনুযায়ী)
গাড়ির মডেল | সিটি মাইলেজ (কিমি প্রতি লিটার) | হাইওয়ে মাইলেজ (কিমি প্রতি লিটার) |
Toyota Axio | 12-14 km/l | 18-20 km/l |
Honda Vezel | 14-16 km/l | 20-22 km/l |
Suxuki Swift | 15-17 km/l | 18-20 km/l |
টিপসঃ গাড়ির অফিসিয়াল ওয়েবসাইট বা রিভিউ দেখে মাইলেজ যাচাই করুন।
৫। গাড়ির বৈশিষ্ট্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
নিরাপত্তা ও আধুনিক ফিচারের দিক থেকেও গাড়ি কেনার আগে মূল্যায়ন করা জরুরি।
নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যঃ
- এয়ারব্যাগ
- ব্রেক অ্যাসিস্ট (ABS)
- ট্রাকশন কন্ট্রোল
- ব্যাক ক্যামেরা ও পার্কিং সেন্সর
সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যঃ
- অটোমেটিক গিয়ার
- টাচস্ক্রিন নেভিগেশন
- ক্লাইমেট কন্ট্রোল
- স্মার্ট এন্ট্রি ও পুশ-স্টার্ট
টিপসঃ আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী ফিচার বেছে নিন, কারণ বেশি ফিচার মানেই বেশি দাম।
৬। কাগজপত্র যাচাই করুন
গাড়ি কেনার সময় নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র যাচাই করা প্রয়োজনঃ
নতুন গাড়ির জন্য
- রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট
- বীমার কাগজ
- ম্যানুফ্যাকচারিং ওয়ারেন্টি
ব্যবহৃত গাড়ির জন্যঃ
- পূর্বের মালিকের নামের কাগজ
- ট্যাক্স ও ফিটনেস সার্টিফিকেট
- গাড়ির সার্ভিস হিস্ট্রি
টিপসঃ কোনো সন্দেহ হলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (BRTA) ওয়েবসাইটে গাড়ির তথ্য যাচাই করুন।
৭। টেস্ট ড্রাইভ করুন
গাড়ির পারফরম্যান্স বোঝার জন্য টেস্ট ড্রাইভ অত্যন্ত জরুরি।
টেস্ট ড্রাইভের সময় কী পরীক্ষা করবেন?
- স্টার্টিং ও এক্সিলারেশন ঠিক আছে কিনা
- ব্রেকিং সিস্টেম ভালোভাবে কাজ করছে কিনা
- গিয়ার পরিবর্তনের সময় কোনো ঝুঁকি লাগে কিনা
- স্টিয়ারিং ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা
টিপসঃ বিভিন্ন ধরণের রাস্তায় গাড়িটি চালিয়ে দেখুন, যেমন সমতল, খারাপ রাস্তা ও হাইওয়ে।
৮। বিক্রেতার বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করুন
গাড়ি কিনতে গেলে অনেক সময় প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই বিক্রেতার পরিচয় যাচাই করা জরুরি।
যেখান থেকে কেনা নিরাপদ
- অফিসিয়াল ডিলার
- বিশ্বস্ত শোরুম
- অনলাইন মার্কেটপ্লেস (যেমনঃ Bikroy)
টিপসঃ বিক্রেতার সম্পর্কে অনলাইনে রিভিউ খুঁজে দেখুন এবং সরকারি সাক্ষাৎ করে কাগজপত্র যাচাই করুন।
উপসংহার
গাড়ি কেনা শুধু টাকা খরচের বিষয় নয়, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। তাই, সঠিক গবেষণা ও যাচাই-বাছাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাজেট ঠিক করা, গাড়ির ধরণ বাছাই, কাগজপত্র পরীক্ষা, টেস্ট ড্রাইভ এবং বিক্রেতার বিশ্বস্ততা যাচাই করে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে আপনার কেনা গাড়িটি আপনার প্রয়োজনের সঙ্গে মানানসই হবে। ধাপে ধাপে এই নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করলে আপনি আপনার জন্য সঠিক গাড়িটি বেছে নিতে পারবেন।