গাড়ি ডেকোরেশনের দোকান – অযথাই টাকার অপচয়?
বাংলা মোটরকে কেন্দ্র করে ঢাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য গাড়ি ডেকোরেশনের দোকান যা এই শহরের ব্যবহারকারীদের গাড়ির ব্যবহারিক প্রবণতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা দেয়। যদিও এসব দোকান গাড়ি ডেকোরেশনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের ভূমিকা আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিৎ? একটি সাধারণ গাড়ি ডেকোরেশনের দোকানে ঢোকা এক ধরণের ভোগান্তিকর অভিজ্ঞতা। যারা যাবেন তারা দেখতে পাবেন যে – সেসব দোকান ভর্তি গাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার অপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, পণ্যের অযৌক্তিক এবং হাস্যকর দাম আর গাড়ির ব্যবহারকারীকে ঠকানোর যত রকমের ফন্দিফিকির। সোজা কথায় এ ধরণের দোকানগুলো ভীষণ আতঙ্কজনক যায়গা, যদিও যারা গাড়ির ব্যাপারে কম জানেন এবং এসব দোকানের ব্যবসায়িক মূল্যবোধ সম্পর্কে কোন ধারণা নেই তাদের কাছে এ দোকানগুলো খুবই জনপ্রিয়।
কেন এই দোকানগুলো এতটা জনপ্রিয়? এ শহরে এমন একটা যায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে আপনি শান্তিমত আপনার গাড়ির মেরামতের কাজ করাবেন। সুতরাং ‘যারা জানেন’ এই ধরণের সার্ভিস সার্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য তারা এ ধরণের কাজের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কি করতে পারেন?
বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ভর করে সে সব ব্যবহারকারীদের উপর যারা সম্প্রতি নতুন গাড়ি কিনেছেন; হোক সেটা কোন জাঁকজমকপূর্ণ শো-রুম থেকে কেনা ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি কিংবা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি। যেকোন নতুন মালিক চাইবেন তার গাড়িটি সুন্দর দেখাক, অন্যসব গাড়ির চেয়ে সৌন্দর্যের বিচারে এগিয়ে থাক। হতে পারে এদেশের গাড়ি ক্রেতাদের সাদামাটা, রূপালি রঙের সাধারণ টয়োটা গাড়ি বেছে নেয়ার প্রবণতা এ ধরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পেছনের একটি অন্যতম কারণ। তবে এটি সচরাচর সত্যি যে গাড়ি কেনার পরপরই বেশিরভাগ ক্রেতাই গাড়িটি নিয়ে চলে যাবেন সোজা বাংলা মোটর অথবা অন্য কোন গাড়ি “ডেকোরেশন দোকানে”।
সেই মুহূর্ত থেকে গাড়ির সব ধরণের অধঃপতন ঘটতে শুরু করে। আপনার গাড়ির জন্য ভাল পার্টস এবং সঠিক ডিজাইনের পার্টস সম্পর্কে ধারণা না থাকার ফলে গাড়ির মালিক সেসব দোকানদারদের যা-তা বুঝিয়ে গছিয়ে দেয়া সব ধরণের পণ্য কিনতে শুরু করেন। অপ্রয়োজনীয় ট্রিঙ্কলেট যেমন, ক্রোমের প্রলেপ দেয়া সিগন্যাল লাইট কভার থেকে শুরু করে উইং মিরর কভার, ছাদ এবং বুটলীডের জন্য ট্যাকি প্লাস্টিক স্পইলার সব কিছু গছিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায় এসব দোকানদার। নিয়ন? অবশ্যই! কেন নয়? ২০০০ সালের হলিউডে চলে যাওয়া যাক, নিজেকে ভাবা যাক পল ওয়াকার আর নিজের গাড়িটিকে ভাবা যাক মিতসুবিশি এক্লিপ্স। আপনার গাড়ির সাউন্ড সিস্টেমের জন্য নকল চাইনিজ স্পীকার লাগালে কেমন হয়? বিজ্ঞাপনে যা দেখানো হয় বাস্তবে তার অর্ধেক ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যামপ্লিফিয়ারস? গাড়ির হেডলাইটের জন্য এমন সব হালোগেন বাল্ব লাগালে কেমন হয় যেগুলো গরমকালে আপনার হেডলাইট কেসিং নষ্ট করে দেবে? অথবা আপনার হয়ত পছন্দ হতে পারে নকল ব্রেক ক্যালিপার কভার যা ব্যবহারের ফলে ব্রেক প্লাস্টিক গলিয়ে আপনার গাড়ির হাব, বেয়ারিং, ক্যালিপারস এবং আশেপাশের পার্টসগুলোকে নোংরা করে অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার সৃষ্টি করবে।
সব দোকানের অবস্থা আবার একই রকম নয়।
বাংলা মোটরে কিছু কিছু যায়গা আছে যেখানে হাতে অময় নিয়ে ঠিকঠাক ঘুরে দেখলে আপনি বেশ অবাকই হবেন। ঝকঝকে দোকানগুলো পরিহার করুন, কেননা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে এরাই দুই নম্বরি কাজ করে থাকে। বাংলা মোটরের ভেতরের দিকে গেলে আপনি এমন একজনকে পাবেন যে আপনার গাড়ির যে কোন ধরণের ইলেক্ট্রিকাল কাজ করে দেবে এবং আপনার গাড়ির আসল পার্টসগুলোকে সবসময় সচল রাখতে সাহায্য করবে। আফটার মার্কেট সাউন্ড সিস্টেম খুঁজছেন? দেশের বাইরে থেকে কিনুন অথবা অনলাইনে অর্ডার দিন এবং ডিলারদের সাথে দর ঠিক করে লাগিয়ে নিন আপনার গাড়িতে। আপনার যদি গাড়ির ইন্টেরিওর বদলানোর প্রয়োজন হয় তবে আপনি পাবেন সুদক্ষ কারিগর যারা গাড়ির ফিটিং নিয়ে উচ্চ গুণাগুণ সম্পন্ন কাজ করে থাকে, তারা আপনাকে গাড়ির রিস্টোরেশন সংক্রান্ত প্রায় যেকোন ধরণের কাজ করে দিতে পারবে। আপনি এদের বাংলা মোটরেই খুঁজে পাবেন। এরা খুব কম খরচে অসাধারণ সার্ভিস দিয়ে থাকে। আপনার গাড়ির জন্য যদি বাংলা মোটরে টাকা খরচ করতেই হয় তবে ভাল সার্ভিস দেয় এমন দোকানগুলো খুঁজে বের করুন। খুব চকচকে দোকানগুলো পরিহার করুন যারা আপনাকে “ishports air philter” নামের স্টিকার লাগিয়ে ৩,৫০০ টাকা দিয়ে একটি প্লাস্টিক ক্যান বিক্রি করার চেষ্টা করবে। আর যদি চলেই যান তাদের কাছে তবে বড়জোর আপনার গাড়ির জানালার কাঁচ টিন্ট করাতে পারেন তাদের দিয়ে। এই একটা কাজেই এসব দোকান মোটামুটি পারদর্শী।
অথবা আরও ভাল হয় যদি আপনি নিজে এসব করতে পারেন। আপনার গাড়িটি কেনার আগেই ইউটিউব এবং গাড়ি সংক্রান্ত অনলাইন ফোরামে তথ্যগুলো দেখে নিন। সেখান থেকে আপনি সহজেই শিখে নিতে পারবেন আপনার গাড়ির খুঁটিনাটি পার্টস সম্পর্কে এবং জানতে পারবেন কিভাবে আপনার গাড়ি কাজ করে। ইন্টারনেট থেকে সাধারণ প্রশিক্ষণ নিতে পারলে আপনি নিজেই গাড়ির স্পীকার লাগাতে পারবেন, রিভার্স ক্যামেরা লাগাতে পারবেন, গাড়ির জানালার কাঁচ নিজেই টিন্ট করাতে পারবেন এবং এমনকি আপনি যে বুটলীড স্পইলার লাগানোর কথা চিন্তা করছিলেন সেটিও আপনি লাগাতে পারবেন নিজে নিজেই। এ ধরণের কাজ করা আসলেই খুব একটা কঠিন কিছু নয়, এ ধরণের কাজে ভুল হবার সম্ভাবনাও থাকে কম। তাছাড়াও আপনি নিজের গাড়ির সাধারণ মেরামত, সংযোজন এবং প্রতিস্থাপনের কাজগুলো যখন নিজেই করবেন তখন আপনার মনে হবে আপনি কিছু অর্জন করেছেন। গাড়ির সাথে আপনার এক ধরণের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে যা কিনা অমূল্য।