কর্পোরেট নারী : বাংলাদেশে নারী নেতৃত্বের ভূমিকা
সাধারণত, বাঙালি মেয়েরা শিক্ষাক্ষেত্রে খুব সীমিত সুযোগ নিয়ে গড়ে ওঠে, যা তাদের চাকরিক্ষেত্রে সুযোগলাভের সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের সরকারী এবং বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রেই নারীরা ক্রমবর্ধমান হারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্র-ঋণ প্রোগ্রামের মাধ্যমে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে, শিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটিয়ে এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে নারীদের স্বাবলম্বী হবার মানসিকতা সৃষ্টি করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও নারীরা যেখানেই পা বাড়াচ্ছে সেখানেই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছে।
একজন কর্পোরেট নারী কিভাবে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারেন? নারীদের কিছু গুণ আছে যা তাদের সব রকম উপযুক্ত ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করে। নারীরা সহানুভূতিশীল এবং তারা অর্থপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন। তাদের ভাবের আদান-প্রদান রীতি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তারা কোন রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই সবসময় প্রশ্ন করার জন্য প্রস্তুত থাকেন। তারা মতামত, পরামর্শ এবং সাহায্য গ্রহণের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকেন। তাদের সতর্ক থাকারও একটি প্রবণতা আছে। তারা বুঝার জন্য এবং শিখার জন্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। তারা মানুষের দুর্বলতাগুলোর চেয়ে সামর্থ্যকে বেশি বড় করে দেখেন। তারা কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও বেশ সময় নিয়ে চিন্তা করেন এবং যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান করার গুনাবলী রাখেন।
এটি একটি বিষয় যে নারীরা তাদের বিশেষ মানসিকতার কারণে কর্মক্ষেত্রে কিছু প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পেয়ে থাকেন। প্রথমত, একটি চাকরির জন্য যথার্থ যোগ্যতা থাকা বাঞ্ছনীয়। কর্পোরেট পরিবেশে যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য নারীদেরকে বিশেষভাবে প্রচেষ্টা করতে হয়। এক্ষেত্রে যোগ্যতার পরিমাপক কর্মক্ষমতা-নির্দিষ্ট। সুতরাং তারা প্রত্যয়ের সাথে কাজ করতে পারেন। তৃতীয়ত, নারীদেরকে তাদের সংসার এবং কর্মক্ষেত্র একসাথে সামলে কাজ করতে হয় বিধায় তাদের চাপ সহনশীলতা অনেক বেশি। পাশাপাশি, নারীদের মস্তিষ্কের জীনগত বিশেষ গঠনের সুবাদে তারা একই সাথে পাশাপাশি একাধিক কাজ প্রক্রিয়া করার ক্ষমতা রাখেন। একই সময়ে পাশাপাশি কয়েকটি কাজ প্রক্রিয়া করার এই অভ্যাসটি তাদেরকে অনেকক্ষেত্রে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে, দ্বীপে অথবা বস্তিতেই উন্নয়নশীল কার্যক্রম নারীরা সংগঠিত করছে এবং নেতৃত্ব দিচ্ছে। স্কুল এবং কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার কাজ করছেন নারীরাই। স্বাস্থ্য এবং যোগাযোগ সেক্টরের কর্মক্ষেত্রে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি থাকায় এই ক্ষেত্রগুলো নারীদের জন্য যথার্থ। বাংলাদেশে নারীদের কর্মসংস্থানের উপর উচ্চতর শিক্ষা এবং ক্ষুদ্র-ঋণ দুটোরই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে।
বাংলাদেশের পাবলিক সেক্টরে নারীরা অনেক উপরের অবস্থান লাভ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নারীরা দেশ শাসন করছেন ১৯৯১ সাল থেকে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে নারীদের সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৫০টি। বর্তমানে ৭০ জন নারী এই গঠনপ্রণালীর অধীনে কাজ করেন যখন স্থানীয় নিয়ন্ত্রক বোর্ডে নারীরা আরও ১৪,০০০ আসন ধারণ করে আছেন। সকল সরকারি চাকরির ১০% নারীদের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। নারীরা এখন সামরিক বাহিনীতেও অংশগ্রহণ করতে পারেন এবং ইউএন শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ গ্রহণ করতে পারেন।
নারী নেতৃত্বের বিষয়টি যদি আমরা দেখি তবে বলা যায় একটি মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার চেয়ে অনেক দূরে এগিয়ে আছে। নারীরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে পরিচালনা করছে সেই ১৯৯১ সাল থেকে, যেখানে আমেরিকা এখন পর্যন্ত নারীদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা প্রদান করতে দ্বিধাগ্রস্ত। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এবং ২০০৯ সালে তিনি আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এবং ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। তারা গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের অবস্থান পালাবদল করেছেন যা অন্য যে কোন দেশের সাথে তুলনা করলে বেশ সবিশেষ একটি বিষয়। পৃথিবীর অন্য কোন নেত্রী এত জনসংখ্যাবহুল রাষ্ট্র পরিচালনা করেননি একমাত্র ইন্দিরা গান্ধী ছাড়া যার দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৬৫ মিলিয়ন। বাংলাদেশি এই দুই নেত্রী আরও প্রমাণ করেছেন যে নারীদেরকে পুরুষদের থেকে পিছিয়ে পড়ার কোন প্রয়োজন নেই, বিশেষ করে একটি মুসলিম-প্রধান দেশে।
পুরুষ শাসিত শিল্পে কাজ করা কখনও কখনও বেশ কঠিন একটি বিষয়। সমস্যা থাকতেই পারে তবে সনাতন সাংস্কৃতিক বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত সমস্যা সহজেই সমাধান করা সম্ভব। নারীদেরকে তাদের বাড়িতে নিজেদের ন্যায্য অবস্থানকে দৃঢ় করার জন্য হতে হবে আরও স্পষ্টভাষী। বর্তমান বাংলাদেশে আরও বহু সংখ্যক নারীরা কর্পোরেট পদগুলোতে অবস্থান করতে পারেন। এবং এটি সম্ভব হত না যদি কিনা পরিবার এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে যথাযথ বোঝাপড়া না থাকে। সুতরাং সমঅধিকার নিয়ে বিতর্ক করার পরিবর্তে নারীরা তাদের নিজেদের জীবনের হাল ধরার সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে এবং তাদের যোগ্যতা দিয়ে তাদের প্রাপ্য অর্জন করে নিতে হবে। 👸