নারী স্বাস্থ্যবিধি সচেতনতা ও আমাদের কর্তব্য
ঘর, সংসার,সামাজিক দায়-দায়িত্ব এসবের ঝক্কি সামলে আমরা নারীরা প্রতিনিয়তই নিজেকে শারীরিক ও মানসিক চাপের মুখে ফেলে দেই। কিন্তু আমরা সুস্থ থাকলেই যে চারপাশের সবকিছুকে আরও ভালোভাবে সামাল দিতে পারবো- সেটা অনেক সময়ই বুঝতে পারি না। গত ২৫ অক্টোবর, ২০১৮ তে Bikroy এর নারী সদস্যদের জন্য আয়োজিত “নারী স্বাস্থ্যবিধি সচেতনতা”-মূলক সেশনে জিসকা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড -এর পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন প্রফেশনাল হেলথ অ্যাডভাইজার ও পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট – ডাঃ রাইয়াতুন তেহরিন। এই সেশনে তিনি নারীদের স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত নানা বিষয় তুলে ধরেন ও Bikroy এর নারী সদস্যদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক নারী স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতাগুলো কখন ও কিভাবে হয়ঃ
- অসচেতনতা
- রোগ প্রতিরোধে অক্ষমতা
- নিয়মিত শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা না করানো
- ঋতুস্রাব/ঋতুচক্র
- সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ (এস টি আই) বা যৌন সংক্রামিত রোগ
- শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন
- গর্ভধারণ
উপরোক্ত পরিস্থিতিগুলোই পরবর্তীতে বড় আকার ধারণ করে কেননাঃ
- আর্থিক পরিস্থিতি
- সামাজিক বাধা
- নারী চিকিৎসকের কম অনুপাত
- স্বাস্থ্যসচেতনতা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব
এ পর্যায়ে আমরা আলোচনা করব নারীদের কিছু কমন স্বাস্থ্য সমস্যা ও তার প্রতিকার সম্পর্কেঃ
মেন্সট্রুয়াল ক্র্যাম্পিংঃ
মেন্সট্রুয়াল ক্র্যাম্পিং হচ্ছে মেন্সট্রুয়েশন বা পিরিয়ডের সময় পেটে বা পিঠের দিকে ব্যাথা হয়। এই ব্যাথাকেই মেন্সট্রুয়াল ক্র্যাম্প বলে। প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন নামক হরমোনের প্রভাবে জরায়ুর সংকোচনের কারণে এই ব্যাথা অনুভূত হয়। এই প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন অতি মাত্রায় নিঃসরণ হলেই কোমর বা তলপেটে ব্যাথা, বমি বমি ভাব, ক্ষুধামন্দা, মুড সুয়িং বা অল্পতেই বিরক্তভাব হয় এবং মাথা ঘুরায়। এই ক্ষেত্রে ব্যায়াম সাহায্য করে তবে পিরিয়ডের সময় খুব জটিল কোনো ব্যায়াম করা সবিধাজনক না। খুব হালকা ব্যায়াম করা যেতে পারে যাতে করে ব্যায়ামও হবে আবার শরীরের উপরও খুব বেশি চাপ পড়বে না।
প্রি মেন্সট্রুয়াল সিন্ড্রোম (পি এম এস) টিপসঃ
- সর্বদা কিছু না কিছু কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন
- খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনুন
- ক্যাফেইন সেবনের মাত্রা কমিয়ে দিন
- ইয়োগা বা মেডিটেশনের সাহায্য নিন
- সামাজিকভাবে মেলামেশা বাড়িয়ে দিন
পিরিয়ড চলাকালীন কিছু টিপসঃ
- সঠিক পরিচ্ছন্নতা এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন
- শরীরের অপরিহার্য পুষ্টি সরবরাহ একটি সুষম খাদ্য খাণ
- চাপ এবং টেনশন এড়াতে সক্রিয় জীবনধারা বজায় রাখুন
- সর্বদা আপনার সময়ের জন্য পৃথক আন্ডারওয়্যার রাখুন
- দাগ এড়াতে ভালমানের স্যানিটারি প্যাড বা ন্যাপকিন ব্যবহার করুন
- নিয়মিত প্রতি চার ঘন্টা পর প্যাড বা ন্যাপকিন পরিবর্তন করুন
- সাবান বা ভ্যাজাইনাল ওয়াশ জাতীয় পণ্য ব্যবহার করবেন না
ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (ইউ টি আই)ঃ নারীদের মধ্যে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন একটি প্রচলিত সমস্যা। পর্যাপ্ত পানি পান না করা, জীবাণুর সংক্রমণ ইত্যাদি কারণে এ সমস্যা হতে পারে। ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা ইউ টি আই ব্লাডারে হতে পারে। এটি বয়ঃসন্ধিদের হতে পারে, যেকোনো নারীর হতে পারে এবং ছেলেদেরও হতে পারে। তবে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সমস্যাটি বেশি হয়। একবার এ রোগে আক্রান্ত হলে পরবর্তীতে আবারো এ সমস্যায় পরার সম্ভাবনা ২০% বেড়ে যায়। তাই এটি এড়াতে প্রচুর পানি পানের পাশাপাশি সঠিক পরিচ্ছন্নতা এবং পরিচ্ছন্নতা মেনে চলুন।
ব্রেস্ট বা স্তন ক্যান্সারঃ ফুসফুসের ক্যান্সারের পর নারীদের মধ্যে দ্বিতীয় ভয়াবহ যে রোগটি হয় তা হচ্ছে ব্রেস্ট ক্যান্সার। স্তনে বা বগলে কোন চাকা, স্থায়ী ব্যথা, নিপলের আশেপাশে লালচে ভাব বা তরল নিঃসরণ, নিপল বসে যাওয়া, স্তনের আকার পরিবর্তন, চামড়া উঠে যাওয়া ইত্যাদি কোন লক্ষণকেই অবহেলা করা যাবেনা। পুরুষদেরও ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে পারে, তবে নারীদের ক্ষেত্রে এর ঝুঁকি প্রায় একশ গুণ বেশী। তুলনামূলক কম বয়সে মাসিক শুরু হওয়া, মেনোপজ দেরীতে হওয়া, বেশী বয়সে প্রথম সন্তানধারণ অথবা একেবারেই সন্তান না হলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশী থাকে। এছাড়া শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা, অ্যালকোহল আসক্তি, রেডিয়েশন বা হরমোন থেরাপীতে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে। ব্রেস্ট ক্যান্সারের একটি সমস্যা হল অনেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিক অবস্থায় লক্ষণগুলোকে উপেক্ষা করতে করতে এমন পর্যায়ে গিয়ে ধরা পড়ে যখন ক্যান্সার অনেকখানি ছড়িয়ে গেছে, তেমন কিছু আর করার থাকে না। তাই এ রোগের ঝুঁকিগুলোর ব্যাপারে সচেতন হোন, এবং নিজের দিকে খেয়াল রাখুন।
সারভাইক্যাল ক্যান্সার বা জরায়ুমুখের ক্যান্সারঃ মহিলাদের জরায়ুর নিচের অংশ অর্থাৎ সারভিক্সের কোষ যখন অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে তখনি দেখা দেয় সারভাইক্যাল ক্যান্সার তথা জরায়ুমুখের ক্যান্সার। এর কারণ হিসেবে একটি ভাইরাসকে চিহ্নিত করা হয়েছে যার নাম হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচ পি ভি)। সাধারণত এই ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে পড়ে। তবে এইচ পি ভি অনেক রকমের হয়ে থাকে এবং সবগুলো সারভাইক্যাল ক্যান্সারের জন্য দায়ীও নয়। তাই মহিলারা প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর, বিশেষ করে বিয়ের পর তাদের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা গেলেও, এটি নিজে থেকে সেরে যেতে পারে বা জননতন্ত্রের আঁচিল তৈরী করতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই সংক্রমণ জরায়ুমুখের ক্যান্সারে রূপ নেয়।
সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ (এস টি আই) বা যৌন সংক্রামিত রোগঃ সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ (এস টি আই) বা যৌন সংক্রামিত রোগ যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির কাছ থেকে অন্যের কাছে ছড়ায়। যেমনঃ এইচ আই ভি, হেপাটাইটিস বি, গনরিয়া, সিফিলিস, হারপিস ইত্যাদি। নিরাপদ যৌন মিলনের জন্য কনডম ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া গর্ভপাত এড়াতে অস্থায়ী পদ্ধতি গর্ভনিরোধক পিল বা ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিল, ইনজেকশন এবং স্থায়ী পদ্ধতি হিসেবে পুরুষ বন্ধ্যাকরণ (ভ্যাসেকটমি) বা মহিলা বন্ধ্যাকরণ (টিউবেকটমি) করা যেতে পারে। তবে কনডম ছাড়া আর কোনটিই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করা উচিত নয়।
আমাদের নিত্যদিনের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনে একটু পরিবর্তন আনলে সহজেই এড়ানো সম্ভব অনেক স্বাস্থ্যগত জটিলতা। দেখে নেওয়া যাক এর কিছু উদাহরণঃ
- উচ্চ আঁশযুক্ত তরিতরকারি ও ফলমূল গ্রহণ করা
- প্রত্যেকদিন অন্তত ৩ লিটার পানি পান করা
- রাতে অন্তত আট ঘণ্টার ঘুমানো
- সকাল ১০-বিকাল ৪ টার মধ্যে নিয়মিত সূর্যরশ্নির মধ্যে প্রতিদিন কিছু সময় কাটানো
- নিয়মিত কিছুসময় ব্যায়াম/শরীরচর্চা করা
সুতরাং বলা যায় যে, লজ্জা বা অবহেলা নয় স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে চাই সচেতনতা আর একটু নিয়ম মেনে চলা।