অতীতের ফ্ল্যাগশিপ বনাম বর্তমানের মিডরেঞ্জার
পুরনো জিনিসই ভাল তাই না? প্রযুক্তির বিশ্বে কথাটি হয়ত সঠিক নয়। আজ আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই যা বহুবার আমার মাথায় এসেছে – আপনি কি একই দামে একটি আধুনিক মাঝারি মানের স্মার্টফোন কিনবেন নাকি দুই বছরের পুরনো ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোন কিনবেন? এই বিতর্কের সাপেক্ষে আমি স্যামসাং গ্যালাক্সি নোট ৪ (অক্টোবার ২০১৪ সালে বাজারে আসা স্যামসাং-এর সর্বকালের অন্যতম সেরা স্মার্টফোন) এবং হুয়ায়েই জিআর৫ ২০১৭ (৩ জিবি র্যাম/৩২ জিবি রম) যা হনার ৬এক্স নামে বাজারে পরিচিত (অক্টোবার ২০১৬-তে বাজারে আসা)। আমি এই স্মার্টফোন দুটি কয়েকটি কারণে বেছে নিয়েছি-
- বর্তমানে এদের মূল্য প্রায় একই, ২১,০০০ টাকা
- দুটো ফোনই ফ্যাবলেট
- দুটো ফোনই বাজারে আসার সময় ক্লাস হিসেবে ছিল সেরা
- আমি দুটো ফোনই রিভিউ করেছি এবং বিস্তারিতভাবে ব্যবহার করে দেখেছি
নকশা এবং গড়ন
নোট ৪ স্যামসাং-এর প্রথম প্রিমিয়াম মানের ফোন। দৃঢ় মেটাল চেসিস সহ এটার একটি রিমুভেবল প্লাস্টিক ব্যাক ছিল। নোট ৪-এর সমতল পেছনের এবং পাশের অংশ ছিল সে সময়ের একটি অনন্য এলিমেন্ট যখন সমান্তরাল রেখা ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়। জিআর৫ ২০১৭-এর নকশা আরও আধুনিক যার পেছনের মেটাল অংশটি কিছুটা বক্রাকৃতির যা খুবই আরামদায়ক। যখন নোট ৪ এখনও দেখতে এবং ব্যবহার করতে অসাধারণ লাগে, জিআর৫ ২০১৭ আধুনিক ট্রেণ্ড অনুযায়ী আরও উপযোগী। নোট ৪-এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এর নমনীয়তা। পেছনের রিমুভেবল কভার ব্যাটারী বদলাতে এবং অন্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র যেমন ওয়্যারলেস চারজিং প্যাড এবং বর্ধিত ব্যাটারী স্থাপন করার জন্য বিশেষ ভাবে সহায়ক। দুই বছর আগে হয়ত এই ফোনটি নিয়ে এক রকম মাতামাতি ছিল তবে বর্তমানে আমরা আরও কম্প্যাক্ট এবং মার্জিত ফর্ম ফ্যাক্টর নিয়ে চিন্তা করি। যে বিষয়টিতে জিআর৫ ২০১৭ কিছুটা পিছিয়ে আছে তা হল এর গড়নের মান। দুটি ফোনই যখন আমি ইচ্ছাকৃতভাবে হাত থেকে ফেলে দিয়েছি তখন এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, নোট ৪-এর চেসিসটি অনেক মজবুত যা জিআর৫ ২০১৭-এর সাথে কোনভাবেই তুলনাযোগ্য নয় কেননা পেছনের মেটাল প্লেট ফোনের বডির সাথে স্ক্রু দিয়ে লাগানো নেই এবং এটি প্লাস্টিক দিয়ে উপরে এবং নিচে বৃত্তাকারে মোড়ানো।
উইনার: নোট ৪
ডিসপ্লে
নোট ৪ ছিল ২কে ডিসপ্লে সহ প্রথম ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোন এবং এখন পর্যন্ত এটি একটি অসাধারণ ফোন। স্যামসাং-এর এমোলেড স্ক্রীন বহুদিন ধরে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন এবং এখন পর্যন্ত একই খ্যাতি বজায়ে রেখেছে। নোট ৪-এর স্ক্রীন দেখতে অন্যান্য অনেক ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোনের (আমি এইচটিসি, ব্ল্যাকবেরী এবং অ্যাপেলের কথা বলছি) চেয়ে ভাল এবং সুরুচিপূর্ণ ২.৫ডি গ্লাস দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত। নতুন স্যামসাং প্যানেল দেখতে আরও ভাল তবে মাঝারি পরিসীমার শ্রেণীর, ২কে আর কোথাও পাওয়া যায় না। জিআর৫ ২০১৭-এর ডিসপ্লেও খুবই সুন্দর কিন্তু এই ক্ষেত্রে এর ১০৮০পি আইপিএস প্যানেল একদমই ছায়াচ্ছন্ন।
উইনার: নোট ৪
সফটওয়্যার
আমি টাচউইয একেবারেই ঘৃণা করি, বিশেষ করে নোট ৪-এর ভার্সনে যেটি ব্যবহৃত হয়েছে। এটি অনেক ধীরগতির, বাজে এবং অনেক সেকেলে। এটি কাস্টোমাইজ করার সুযোগ খুবই কম, সেহেতু আমি সবসময় নোভা লঞ্চার নামের একটি সবসময় একটি থার্ড পার্টি অ্যাপ ব্যবহার করতাম। জিআর২০১৭-এর সফটওয়্যার আরও স্বচ্ছন্দ, দ্রুতগতির এবং দেখতে অনেক ভাল। আপডেট অনুসারে নোট ৪ জিআর৫ ২০১৭-এর মত অ্যান্ড্রইড ৬.০ মারশমেলোর উপর ভিত্তি করে তৈরি এবং এটি ডিসেম্বার সিকিউরিটি প্যাচ পর্যন্ত গ্রহণ করেছে। নোট ৪-এর জন্য এটিই সম্ভবত শেষ আপডেট যেখানে জিআর৫ ২০১৭ অবশ্যই অ্যান্ড্রইড ৭.০ নৌগাট এবং তারপরের আপডেটগুলো পর্যন্ত পেতে থাকবে। আপডেট অন্যতম একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় যা একজন ব্যবহারকারীর বিবেচনা করা উচিৎ কেননা এর মাধ্যমে স্মার্টফোন ব্যবহারের অভিজ্ঞতা বর্ধিত করা সম্ভব।
উইনার: জিআর৫ ২০১৭
কর্মক্ষমতা
এটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ। সময়ের সাথে সাথে সিপিইউ আরও দ্রুতগতির এবং সস্তা হচ্ছে এবং জিপিইউ এবং র্যামের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য। দুটো ফোনেরই ৩ জিবি র্যাম, ৩২ জিবি বিস্তারযোগ্য বিল্টইন স্টোরেজ এবং বড় ব্যাটারি আছে। জিআর৫ ২০১৭-এর ব্যাটারির ধারণক্ষমতা সামান্য কিছুটা বেশি (৩৩৪০ এমএএইচ বনাম ৩২২০ এমএএইচ)। দুটো ফোনের সাদৃশ্য এ পর্যন্তই। নোট ৪-এর কোয়াড কোর ২.৭ গিগাহার্টজ স্ন্যাপড্রাগণ ৮০৫ প্রসেসর শুনতে বেশ ভালই লাগে, কিন্তু বাস্তবে এটি জিআর৫ ২০১৭-এর অক্টা কোর কিরিন ৬৫৫ (৪X২.১ গিগাহার্টজ + (৪X১.৭ গিগাহার্টজ)-এর তুলনায় একটি স্বল্প কার্যক্ষম সমন্বয়। গেম খেলার ক্ষেত্রে পারফরম্যান্সের পার্থক্য উপেক্ষণীয়, তবে জিআর৫ ২০১৭-এর পারফরম্যান্স কম রেজোলুশনের স্ক্রীন হওয়ার কারণে কিছুটা উন্নত। ব্যাটারী লাইফের কথা চিন্তা করলে নোট ৪ পরাস্ত। এখনকার ব্যবহারিক ধরণের কথা চিন্তা করলে নোট ৪-এর ব্যাটারী কোন রকমে একটি সম্পূর্ণ দিন পর্যন্ত চালাতে সক্ষম যেখানে জিআর৫ ২০১৭-এর ব্যাটারী সহসাই দেড় দিন পর্যন্ত চালাতে পারে। দুটো ফোনেরই ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার রয়েছে তবে নোট ৪-এর স্ক্যানার অনেক ধীরগতি সম্পন্ন, পুরাতন এবং সোয়াইপের উপর ভিত্তি করে তৈরি। জিআর৫ ২০১৭-এর স্ক্যানার অসাধারণ।
উইনার: জিআর৫ ২০১৭
ক্যামেরা
এই দুটো ফোনের তুলনা শুরু করার আগে, একটি ট্রেন্ড যা আমি দেখেছি যে মিডরেঞ্জ ডিভাইসের ক্যামেরা সাধারণত খুব একটা ভালভাবে কাজ করে না, পুরনো ফ্ল্যাগশিপ আরও ভাল ইমেজ এবং ভিডিও কোয়ালিটি ফিচার করে। যদিও এই তুলনাটি একটু ভিন্নতর যেহেতু জিআর৫ ২০১৭ ডুয়াল ক্যামেরা ফিচার করে এবং ভিডিও মোডে ম্যানুয়াল কন্ট্রোল ফিচার করে। নোট ৪-এর সামগ্রিক ইমেজ এবং ভিডিও কোয়ালিটি সেরা কিন্তু জিআর৫ ২০১৭ লো-লাইটের ক্ষেত্রে ভাল কাজ করে। ডুয়াল ক্যামেরা জিআর৫ ২০১৭-কে এমন একটি প্রান্তে স্থাপন করে যা একটি অনন্য ডেপথ অব ফিল্ড চেঞ্জিং মোড এনে দেয় যা ব্যবহারের সময় সত্যিই বিস্ময়কর কাজ করতে পারে। পুরোপুরি ম্যানুয়াল ভিডিও কন্ট্রোল বাজেট কন্টেন্ট তৈরিকারকদের জন্য একটি স্বপ্ন কিন্তু এরা অপটিক্যাল ইমেজ স্ট্যাবিলাইজেশনের অভাবে মার খেয়ে যায়। জিআর৫ ২০১৭-এর যখন ডুয়াল ক্যামেরা একটি ইউনিক সেলিং পয়েন্ট, সেখানে আমার মতে নোট ৪-এর শুধুমাত্র উন্নত কোয়ালিটির সেন্সর রয়েছে।
উইনার: নোট ৪
দীরঘমেয়াদি ব্যবহারযোগ্যতা এবং উপসংহার
যখন উপরে উল্লিখিত পয়েন্টগুলো সবই খুব গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল ফোনের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারযোগ্যতা। নতুন সাশ্রয়ী মূল্যের বিকল্পগুলো যখন উন্নততর প্রযুক্তি নিয়ে আসে, তখন পুরনো ফ্ল্যাগশিপগুলো তাদের সময়ের সর্বোচ্চ টেকনোলজি ধারণ করে। আমার মতে, পুরনো ফ্ল্যাগশিপ ফোন কেনার সবচেয়ে বড় বাজে দিক হল সেগুলোর সফটওয়্যার আপডেটের সুযোগ কম যা সফটওয়্যারের সিকিউরিটি এবং ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিরক্তির কারণ। প্রত্যেক পুনঃসংস্করণের সাথে সাথে অ্যান্ড্রইড সাধারণভাবে এমন উন্নত হয়েছে যে আপডেট না পেলে তা আপনাকে সত্যিই অনেক পিছিয়ে দেবে। পরিশেষে বলতে চাই, পুরনো ফ্ল্যাগশিপ ফোনগুলো আপনি কিনতে পারেন যদি আপনি অপেক্ষাকৃত ভাল ক্যামেরা এবং ডিসপ্লে চান। আর যদি ভাল ব্যাটারি এবং স্মার্টফোন কমিউনিটির সাথে হালনাগাদ থাকতে চান তবে মিডরেঞ্জের নতুন ফোন কিনুন।