এবারের ফুটবল বিশ্বকাপ ২০১৮ আর বাঙালি ভক্তদের উন্মাদনা
আসছে ১৪ই জুন রাশিয়ায় শুরু হতে যাচ্ছে এবারের ফিফা বিশ্বকাপ ২০১৮। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের ফুটবলপ্রেমীরা এই মহা উৎসবকে ভালোবেসে ‘ফুটবল বিশ্বকাপ’ নামে চেনে। বিশ্বব্যাপী স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে জনপ্রিয়, সুশোভিত আর সত্যিকার অর্থে বৈশ্বিক এক উৎসব এই ফুটবল বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ আসার আগেই প্রতিবার সারা বিশ্বে সাড়া পড়ে যায়। এবার ফিফা বিশ্বকাপের ২১তম আসর রাশিয়ার ১১টি শহরের মোট ১২টি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মানুষ এখানে দেখতে পাবেন ৩২টি বাছাই করা দেশ হতে ফুটবল জগতের অনন্য কিছু প্রতিভা, খেলার মাঠে যাদের প্রতিটি পদক্ষেপ দর্শকদের মাতিয়ে রাখবে।
বিশ্বকাপ নিয়ে মাতামাতির ক্ষেত্রে বাঙ্গালিদের উত্তেজনা সারা পৃথিবীর তুলনায় অনেকটাই কম মনে হতে পারে। তবে ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে বাঙালির উন্মাদনা কিন্তু কোন অংশেই কম নয়। উন্মত্ত ভক্তদের কথাই বলুন, কিংবা নাটকীয় রেষারেষি, লক্ষ লক্ষ পতাকা আর জার্সি, অথবা লাখো মানুষের আবেগ, সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ফুটবল নিয়ে পাগলামির সব নিদর্শনগুলো দেখার মত – পুরো ব্যাপারটা সত্যিকার অর্থে এদেশের জন্য এক জাতীয় উৎসব হয়ে ওঠে!
ঘরে ঘরে স্টেডিয়াম : দ্বিগুন হলো উদযাপনের আনন্দ
যেহেতু বাংলাদেশের বেশিরভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় ২টি ইসলামিক উৎসবের মধ্যে বছরের প্রথম উৎসব ঈদ উল ফিতর আসছে চলতি বছরের ১৬ কিংবা ১৭ জুন (হিজরি চন্দ্রবছর অনুযায়ী চাঁদ দেখা সাপেক্ষে)। বিশ্বকাপ শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই এই উৎসব এসে পড়ায় ভক্তরা সরকারী ছুটির দিনগুলোয় আরাম করে ফুটবল বিশ্বকাপের আমেজ নিতে পারবেন।
বছরের সবচেয়ে বড় স্পোর্টস উৎসব উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে একটি করে সুসজ্জিত স্টেডিয়াম জায়গা করে নেবে টেলিভিশনের রুপ ধরে। এমনিতেই যেকোন উৎসব এলে দারুন সব টিভির বিক্রি বেড়ে যায় বহুগুনে, আর সেখানে ফুটবল বিশ্বকাপ এলে তো কথাই নেই! আগ্রহী ক্রেতারা এক শো-রুম থেকে অন্য শো-রুমে ঘুরে ঘুরে সবচেয়ে সেরা ডিলটি খোঁজ করেন। বিক্রি হবার জন্য এটিই বছরের সেরা সময়, তাই তো বিভিন্ন দোকানের সেলসম্যান, দোকানের মালিক আর টিভি কোম্পানীগুলো দারুন সব অফার নিয়ে আসছেন ভোক্তাদের মন কেড়ে নেবার জন্য।
এখন বড় স্ক্রিনের টিভি যেমন এলইডি, এলসিডি, এইচডি টিভি আর স্মার্ট টিভির অসম্ভব রকম চাহিদা। এই মৌসুমে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে নিঃসন্দেহে ওয়াইফাই সংযোগসম্পন্ন স্মার্ট টিভি। আজকাল বিভিন্ন রকম ডিস্কাউন্ট, ক্যাশব্যাক অফার, সুদহীন ইন্সটলমেন্ট সুবিধা, ডেলিভারি তে ডিসকাউন্টসহ নানা রকম সুবিধা আসার কারণে অধিকাংশ ভোক্তারা অনলাইন শপিং এ আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
প্রত্যেক পরিবারের ছোট-বড় প্রত্যেকটি সদস্য ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে আগ্রহী এবং বড় স্ক্রিনে ‘রাশিয়া লাইভ’ এ লাইভ খেলাগুলো দেখতে চান, বয়স যতই হোক না কেনো। দেশের সরকারী টেলিভিশন সম্প্রচারক ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)’ এইবারের বিশ্বকাপ সম্প্রচারের টিভি রাইট প্রাপ্ত হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তিগত সম্প্রচারক যেমন ‘মাছরাঙ্গা’ ও ‘নাগরিক’ টেলিভিশনও বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য ‘ফিফা বিশ্বকাপ ২০১৮’ তাদের চ্যানেলগুলোয় সরাসরি সম্প্রচার করবে।
মেইড ইন বাংলাদেশ!
এই বছর বাংলাদেশ রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপ শুধুমাত্র ঘরে বসে দেখার চেয়েও বেশি কিছু করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক এবার গর্বের সাথে জানবে ও দেখবে, কিভাবে বিশ্বখ্যাত ফুটবলাররা অসাধারন প্রতিভার সাথে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ লাগানো সামগ্রী পরিধান করে বিশ্বমানের ফুটবল খেলবে। ঠিক ২০১৪ সালের মত এবারও বাংলাদেশ ফুটবল জার্সি, জ্যাকেট, মোজা, শর্টস, জাতীয় পতাকাসহ আরো বিভিন্ন খেলার সামগ্রী রপ্তানী করেছে এ বছরের বিশ্বকাপ আসরে।
দারুন সব রপ্তানী পণ্যের জন্য বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। এক্ষেত্রে এদেশের অধিবাসীদের ভাগ্য খারাপ, কেননা এই রপ্তানীযোগ্য পণ্যগুলো লোকাল মার্কেটপ্লেসগুলোয় পাওয়া যায় না। এইসব প্লেয়ার জার্সি, ফ্যান জার্সি আর বিভিন্ন দেশের ফুটবল জার্সি ব্রাজিল, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, বেলজিয়াম, আর্জেন্টিনা, পর্তুগালসহ আরো বিভিন্ন দেশের ভক্তরা, খেলোয়াড়রা এবং অফিশিয়ালরাও এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপে পরবেন।
ফুটবল জার্সি আর খেলার সামগ্রী রপ্তানীতে বাংলাদেশের এই অর্জন যেমন বড়, তার চেয়েও বড় বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প রপ্তানীর খাত। বৈশ্বিকভাবে আমাদের এইসব অবদান যত বেশি সার্থক হবে ততটাই একটা জাতি ও এর নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য বেশ গর্বেরও বিষয় হবে। বিশ্বব্যাপী এই খাতে বেশি বেশি অবদান রাখার জন্য সরকার ও দেশীয় পোশাকশিল্প ব্যবসায়ীরা সমানভাবে অংশীদার।
এইধরনের উৎসব আমাদের মত স্বল্প আয়ের দেশকে অর্থনৈতিকভাবে বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করে থাকে। অরিজিনালের পাশাপাশি বিভিন্ন রেপ্লিকা ফুটবল জার্সি আর বিভিন্ন দেশের পতাকা ব্যাপক হারে বিক্রি হয়। এছাড়াও বিভিন্ন উচ্চমূল্যের পণ্য যেমন টিভি এর ব্যাবসা এই সময়ে সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে।
অকৃত্রিম ভক্ত, প্রতিদ্বন্দিতা আর অসংখ্য পতাকার মেলা
বাংলাদেশের ভক্তদের অনুরক্ততা নিঃসন্দেহে এক বিস্ময়কর ব্যাপার। হোক সেটা বিশেষ একটা দলের জন্য একনিষ্ঠ সাপোর্ট, ২ দলের ভক্তদের যুগ-যুগান্তরের প্রতিদ্বন্দিতা অথবা খেলার বা কোন দলের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের চূড়ান্ত কোন প্রচেষ্টা, কোনকিছুই বাংলার মানুষদের এই পাগলামির ধারেকাছেও ঠেকতে পারবে না। ধনী কিংবা গরীব, প্রত্যেক ভক্তই তাদের দলকে মনেপ্রানে ভালোবাসেন আর সেই ভালোবাসা প্রদর্শনে কোনরকম কার্পণ্য করেন না।
৬৯ বছর বয়সী আমজাদ হোসেন, এক আশ্চর্য কারণবশত জার্মানির প্রতি তার ভালোবাসা ২০০৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ থেকে। সেবার জার্মানিই ছিলো আয়োজক দেশ। তার মতে তার গলব্লাডারের পাথর হবার চিকিৎসার জন্য একটি জার্মান কোম্পানির ঔষধ তাকে অনেকটাই সুস্থ করে তুলেছে। সেই থেকে এক বিশ্বরেকর্ড গড়বার মত ভালোবাসা জন্ম নিলো তার মনে, আর তিনি সেটা প্রকাশ করলেন সবচেয়ে বড় জার্মান পতাকা বানিয়ে। গত বিশ্বকাপে তিনি তার পতাকার সাইজ আরো বড় করার জন্য তার ধানী জমি বিক্রি করে দেন। আর ঘটনাক্রমে সেইবার জার্মানি বিশ্বকাপ জয়ী হয়।
আমজাদ সাহেবের মত আরো অনেক একনিষ্ঠ ভক্ত রয়েছে সাড়া দেশজুড়ে, বিশেষত ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ভক্তরা। প্রত্যেকটা বাসাবাড়ি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও এপার্টমেন্ট, রাস্তাঘাট, দোকানপাট, যানবাহন ইত্যাদি বিভিন্ন যায়গায় অজস্র পতাকা দিয়ে সাজানো হচ্ছে। দেশে অন্যান্য বিভিন্ন দলের তুলনায় ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার ভক্ত ও প্রতিদ্বন্দিতা সবচেয়ে বেশি আর সবচেয়ে মজাদার। ছোট শিশু, কিশোর থেকে শুরু করে তরুন, মধ্যবয়সী, এমনকি বয়স্করাও তাদের পছন্দের দলকে সাপোর্ট করার ব্যাপারে গলাবাজি আর যেকোন মাত্রায় তাদের ভালোবাসা প্রদর্শন করতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দলের রঙ, জার্সি, পতাকাসহ নানারকম মাধ্যম ব্যবহার করছেন।
এই মৌসুমে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হচ্ছে পতাকা বানানো আর এর বিক্রি। এই কয়েক মাসে বিভিন্ন দেশের পতাকার চাহিদা অত্যন্ত বেশি আর প্রতিদিন হাজার হাজার পতাকা বিক্রিও হচ্ছে। বিশ্বকাপ নিকটবর্তী হওয়ায় বাংলাদেশের পতাকা ছাপিয়ে অন্যান্য পছন্দের দলের পাশাপাশি লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা আর নেইমারের ব্রাজিলের অজস্র পতাকায় সারা দেশের রাস্তাঘাট ছেয়ে গেছে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প খাতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করে থাকেন, যারা সারা বিশ্বে কোটি কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানী করছেন। কিন্তু এই মৌসুমে পতাকা বানানো আর বিক্রির ব্যবসা অনেক দরিদ্র শ্রমিকের বাড়তি ইনকামের পথ খুলে দিয়েছে। বিগত বছরগুলোয় অনেক রকম উন্নয়ন করা হলেও কর্মক্ষেত্রের অনুন্নত পরিবেশ এখনও একটা বড় চিন্তার কারণ। কিন্তু ব্যবসায়ীরা নিজেরা লাভ করবার জন্য শ্রমিকদের কম বেতনে বেশি কাজ করানোর সমস্যাটা এখনো এদেশে রয়েই গেছে।
শেষ কথা
ক্রিকেট সর্বস্ব বাংলাদেশ বিশ্বকাপের এই অল্প কয়টা দিনের জন্য তাদের সমস্ত ভালবাসা আর পাগলামি ফুটবলের জন্য বিলিয়ে দেয়। প্রতি চার বছর পর পর দেশের ১৬ কোটিরও বেশি মানুষ ফুটবলকে ঘিরে এই পাগলামি নিয়ে সময়ে অসময়ে, কাজে অবসরে, দিন ও রাতব্যাপী মত্ত হয়ে থাকে। যেখানেই এই খেলা অনুষ্ঠিত হোক না কেনো, বাংলাদেশের মানুষ স্টেডিয়ামের মতই উদ্দীপনার সাথে খেলা উপভোগ করে থাকে।
সারা বাংলাদেশের ভক্তরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়দের ভালোবেসে তাদের দলের পতাকা সাজিয়ে ও দেখিয়ে, সম্মানের সাথে উদযাপন করে, যেমনটা তাদের নিজেদের দেশের মানুষ করে থাকে।