প্রপার্টি

বাংলাদেশে জমি কেনার সময় যে গোপন খরচগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকা জরুরি

বাংলাদেশে জমি কেনা জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, হোক তা নিজের বাড়ি তৈরির জন্য, ব্যবসা শুরু করার জন্য, কিংবা ভবিষ্যতের বিনিয়োগ হিসেবে। তবে অনেকেই জমির মূল দামের বাইরের গোপন খরচগুলো উপেক্ষা করে থাকেন। এসব অতিরিক্ত খরচ দ্রুতই আপনার বাজেটের ওপর চাপ ফেলতে পারে। তাই এই লেখায় আমরা জমি কেনার সময় যেসব গোপন খরচে পড়তে হতে পারে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করবো যাতে আপনি সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং অপ্রত্যাশিত ঝামেলা এড়াতে পারেন।

১. রেজিস্ট্রেশন ও স্ট্যাম্প শুল্ক ফি

জমি ক্রয় করতে চাইলে সরকারিভাবে রেজিস্ট্রেশন করানো বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশে রেজিস্ট্রেশন ফি ও স্ট্যাম্প শুল্ক মিলিয়ে সাধারণত জমির মূল্যের ১০% থেকে ১৪% পর্যন্ত খরচ হয়, যা এলাকাভেদে ভিন্ন হতে পারে। এটি ক্রেতাদের জন্য সবচেয়ে বড় অতিরিক্ত খরচগুলোর একটি, তাই শুরুতেই বাজেটে এটি ধরে রাখা উচিত।

২. নামজারি (Mutation) ফি

রেজিস্ট্রেশনের পর জমির খতিয়ানে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নামজারি করতে হয়। এর জন্য সরকার নির্ধারিত একটি ফি দিতে হয়, পাশাপাশি যদি দালাল বা আইনজীবীর মাধ্যমে কাজ করান, তাহলে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জও দিতে হতে পারে। বিশেষ করে যদি জমির মালিকানা ইতিহাস জটিল হয়, তবে বিলম্ব বা আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে, যা অতিরিক্ত খরচের কারণ হতে পারে।

৩. জরিপ ও জমি মাপার খরচ

বাংলাদেশে জমির সীমানা নিয়ে বিরোধ খুবই কমন বিষয়। তাই জমি কেনার আগে সঠিকভাবে জরিপ করানো খুব জরুরি। একজন অনুমোদিত সার্ভেয়ার দিয়ে জমির পরিমাপ করালে আইনি দিক থেকে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়, তবে তার জন্য একটি নির্দিষ্ট খরচ গুণতে হবে। জমির আয়তন ও অবস্থান অনুযায়ী খরচ ভিন্ন হতে পারে, তবে ভবিষ্যতের জটিলতা এড়াতে এটি একটি জরুরি বিনিয়োগ।

৪. আইনি পরামর্শ খরচ

জমির মালিকানা যাচাই, দলিল প্রস্তুত, চুক্তিপত্র তৈরি ইত্যাদির জন্য একজন আইনজীবীর সহায়তা প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে আইনজীবীরা সাধারণত নির্দিষ্ট ফি অথবা জমির মূল্যের একটি নির্ধারিত শতাংশ হিসেবে পারিশ্রমিক নেন। যদিও এটি সরাসরি “গোপন খরচ” নয়, তবে অনেক ক্রেতাই এটি অবহেলা করেন বা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করেন না।

৫. অনানুষ্ঠানিক খরচ

কোনো কোনো ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন, নামজারি বা ইউটিলিটি সংযোগের প্রক্রিয়া দ্রুত করতে ঘুষ বা “স্পিড মানি” দাবি করা হতে পারে। এটি বেআইনি হলেও বাস্তবে অনেকেই এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। সব সময় আইনি পথে কাজ করার চেষ্টা করুন, তবে মানসিক ও আর্থিকভাবে এই বাস্তবতার জন্য প্রস্তুত থাকাই ভালো।

৬. ইউটিলিটি সংযোগ খরচ

যদি জমি কোনো উন্নয়নাধীন এলাকায় হয়, তবে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ পেতে আলাদা আবেদন করতে হয়, যা মোটেও সস্তা নয়। নিকটবর্তী সংযোগ লাইনের অবস্থান, প্রয়োজনীয় উপকরণ ও শ্রমিকের খরচ মিলিয়ে মোট ব্যয় অনেক বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় এই খরচ আরও অপেক্ষাকৃত বেশি হতে পারে, কারণ সেবাগুলো পৌঁছানোর জন্য আলাদা অবকাঠামো তৈরি করতে হয়।

৭. জমি উন্নয়নের খরচ

বিশেষ করে শহরতলি বা গ্রামীণ অঞ্চলের প্লটগুলো ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে উন্নয়ন কাজ করতে হয়। এর মধ্যে মাটি ভরাট, জমি সমান করা, ময়লা বা আগাছা পরিষ্কার করা ইত্যাদি কাজ অন্তর্ভুক্ত। এসবের জন্য ট্রাক্টর, শ্রমিক বা নির্মাণ সামগ্রীর প্রয়োজন হতে পারে এবং জমির অবস্থা অনুযায়ী খরচ উল্লেখযোগ্য হতে পারে।

পরিসংহার 

বাংলাদেশে জমি ক্রয় করতে চাইলে নির্ধারিত দামের থেকেও বেশি খরচ করতে হয়। আইনি ফি, রেজিস্ট্রেশন খরচ এবং ভূমি উন্নয়নের মতো গোপন খরচগুলো দ্রুতই ব্যয় বাড়িয়ে দিতে পারে। এসব খরচ সম্পর্কে আগে থেকেই জানা থাকলে পরিকল্পনা করা সহজ হয়ে যায় এবং অপ্রত্যাশিত ঝামেলা এড়ানো যায়। তাই ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সতর্কভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়াই এই ক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের কাজ।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

১. জমি কেনার সময় কি আইনজীবী নেওয়া জরুরি?

হ্যাঁ, একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর সহায়তা নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জমির কাগজপত্র যাচাই, দলিল প্রস্তুত এবং আইনি দিকগুলো নিশ্চিত করতে সাহায্য করবেন।

২. জমির রেজিস্ট্রেশন ফি ও স্ট্যাম্প শুল্ক কত হয়?

রেজিস্ট্রেশন ফি ও স্ট্যাম্প শুল্ক সাধারণত জমির সরকারি মূল্যের ১০% থেকে ১৪% পর্যন্ত হতে পারে, যা এলাকাভেদে পরিবর্তিত হয়।

৩. নামজারি (Mutation) করার প্রক্রিয়া ও খরচ কী রকম?

জমির রেজিস্ট্রেশন শেষে নামজারি করতে হয় যাতে আপনার নামে জমির খতিয়ান তৈরি হয়। এর জন্য সরকার নির্ধারিত ফি ও প্রয়োজনে দালাল বা আইনজীবীর চার্জ দিতে হতে পারে।

৪. বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ পেতে অতিরিক্ত খরচ হয় কি?

হ্যাঁ, যদি প্লটটি ভালো এলাকায় হয়, তবে ইউটিলিটি সংযোগের জন্য আলাদা খরচ হতে পারে। সংযোগের দূরত্ব অনুযায়ী এই খরচ বাড়তে পারে।

৫. জমি কিনতে গিয়ে কীভাবে প্রতারণার হাত থেকে বাঁচা যায়?

জমির কাগজপত্র ভালোভাবে যাচাই করুন, ভূমি অফিস থেকে তথ্য সংগ্রহ করুন এবং সবকিছু আইনগতভাবে সম্পন্ন করুন। সন্দেহ হলে অভিজ্ঞ আইনজীবী বা ভূমি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

Facebook Comments
সাবস্ক্রাইব করুন

No spam guarantee.

Show More

Related Articles

Back to top button
Close
Close