কিভাবে সুন্দর একটি জীবন বৃত্তান্ত (সিভি) লিখতে হয় – পর্ব ২
জীবন বৃত্তান্ত লেখার পদ্ধতি বা ফরমেট সম্পর্কে প্রথম পর্বে আমরা মৌলিক কিছু নীতি অনুসন্ধান করেছি এবং দেখিয়েছি। কিন্তু জীবন বৃত্তান্তের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে এর বিষয়বস্তু। যখন আপনি একটি জীবন বৃত্তান্ত লিখবেন তখন আপনি কোন বিষয়ের উপর পড়াশুনা করেছেন এবং কোন ক্ষেত্রে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার উপর ফোকাস করে উপস্থাপন করা এবং জানানো কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। আপনার সুন্দর একটি জীবন বৃত্তান্ত লেখার জন্য আমরা এখানে কিছু মৌলিক এবং প্রধান টিপস উপস্থাপন করছি। একটা বিষয় সব সময় মনে রাখবেন নিয়োগ পরিচালনাকারীকে (যিনি নিয়োগ কাজের জন্য দায়িত্বে থাকেন) একটি চাকরির যোগ্য প্রার্থী খোঁজার জন্য শত শত অথবা হাজারো জীবন বৃত্তান্ত পড়তে হয়। এমনটিও হতে পারে, নির্দিষ্ট কোন পদে আপনি আবেদন করেছেন যেটির জন্য আপনি একজন যোগ্য প্রার্থী। কিন্তু আপনার লেখা দুর্বল মানের একটি জীবন বৃত্তান্তের কারণে এমন হতে পারে যে আপনি কখনই ইন্টারভিউতে ডাক পাবেন না। তবে এই প্রবন্ধটি পড়া শুরু করার আগে আপনি যদি আমাদের জীবন বৃত্তান্ত (সিভি) সংক্রান্ত ১ম পর্বটি না পড়ে থাকেন তাহলে এখনই পড়ে নিনঃ কিভাবে সুন্দর একটি জীবন বৃত্তান্ত (সিভি) লিখতে হয় – পর্ব ১
চাকরির আলোকে জীবন বৃত্তান্তের বিষয়বস্তু ও পরিচ্ছদ প্রস্তুত করুন
কখনো কোন বিষয়ে কাজ করেছে কিনা এমন সব ছোট-খাটো প্রজেক্ট এবং শর্ট কোর্সের উল্লেখ করে অনেকে মনে করেন তাদের জীবন বৃত্তান্ত পূর্ণ করবেন এবং এটি দিয়ে নিয়োগকারীকে বোঝাবেন যে তিনি অনেক চিত্তাকর্ষক, দক্ষ এবং কঠোর পরিশ্রমী। এটা হচ্ছে নিরর্থক এবং বোকামী। এই কাজটি ওইসব মনুষের মতো যারা নিজেদেরকে শুধু প্রদর্শন করতে চান যে তারা কতটা দক্ষ ও চিত্তাকর্ষক। বাস্তবে নিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এবিষয়ে তেমন কোন আগ্রহই দেখান না।
অবশ্যই মনে রাখবেন, নিয়োগের দায়িত্বে থাকা পরিচালক বা ব্যক্তি কাক্ষিত ওই পদে নিয়োগের জন্য একটি নির্দিষ্ট সেটের দক্ষতা এবং মেধার প্রার্থীকে খুঁজছেন। আপনি কিভাবে নিজেকে চিত্তাকর্ষক এবং আকর্ষণীয় করে তুলবেন সেই চিন্তা করার আগে চিন্তা করুন আপনি যে চাকরির জন্য আবেদন করছেন সেই চাকরি বা পদের জন্য কি কি প্রয়োজন।
আপনি যদি বিভিন্ন ধরণের (পদে) চাকরির জন্য আবেদন করে থাকেন। তাহলে চাকরি খোঁজার ক্ষেত্রে প্রতিটি চাকরি জন্য পৃথক পৃথক জীবন বৃত্তান্ত তৈরি করুন। উদাহরণ স্বরূপ, কল্পনা করুন কেউ একজন শিক্ষকতা এবং মার্কেটিং উভয় পদে চাকরির জন্য আবেদন করছেন। কলেজে পড়ার সময় এই ব্যক্তি বস্তির স্কুলে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন এবং ওই স্কুলের শিক্ষকের সহকারী হিসেবে তাদের প্রফেসরকে সাহায্য করেছেন। আবার তারা গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় কোন একটি বিজ্ঞাপনী কোম্পানিতে অন্তবর্তীকালীন কাজ করেছেন এবং তাদের আর্টিস্ট বন্ধুর ওয়েবসাইটের জন্য কিছু গ্রাফিক ডিজাইনের কাজও করেছেন।
শিক্ষক পদে চাকরির জন্য আবেদন করার ক্ষেত্রে আবেদনকারীর উচিত শিক্ষকতার সেই (কলেজে পড়ার সময়) অভিজ্ঞতা জীবন বৃত্তান্তের প্রথমেই উল্লেখ করা। এরপরপরই শিক্ষকতা করতে গিয়ে তারা যে দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, শিক্ষকতার সাথে সামঞ্জস্য এমন বিষয়গুলো আরও কনক্রিট এবং বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে হবে। তারা যে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করছেন তা জীবন বৃত্তান্তের একেবারে শেষের দিকে সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করতে হবে। ওই ব্যক্তি যে সবদিক দিয়েই ভালো এবং পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে খুব ভালো ভাবেই কাজ করতে পারবে এটা দেখানোর জন্যই বিজ্ঞাপনী সংস্থার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে হবে। তবে সেটা অবশ্যই দুই বা তিন লাইনের বেশি না।
মার্কেটিংয়ে চাকরির জন্য ওই চাকরি প্রার্থীকে অবশ্যই পৃথক জীবন বৃত্তান্ত তৈরি করতে হবে। এখানে প্রথমেই উল্লেখ করতে হবে গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতা এবং বন্ধুর ওয়েবসাইটে গ্রাফিক ডিজাইনের করা কাজের অভিজ্ঞতা। শিক্ষকতার যে অভিজ্ঞতা আছে সেটা উল্লেখ করতে হবে, তবে তা অবশ্যই অল্প কয়েক লাইনের বেশি হবে না।
মনে রাখুন: জীবন বৃত্তান্ত অবশ্যই সংক্ষিপ্ত আকারে হওয়া উচিত। এক পাতার জীবন বৃত্তান্তই হলো আদর্শ জীবন বৃত্তান্ত। যে চাকরির জন্য আবেদন করছেন সেই চাকরির সাথে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতাকে সিভি লেখার সময় বেশি আলোকপাত করুন। পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রম জীবন বৃত্তান্তের শেষে এক লাইনের মধ্যে খুব সহজ করে উল্লেখ করা যেতে পারে।
স্ট্রং বিষয় : যোগ্যতার সামারি দিয়ে শুরু করুন
অনেক জীবন বৃত্তান্তই শুরুতে এক লাইনের সংক্ষিপ্ত সারাংশের (সামারি) বর্ণনা দিয়ে শুরু করা হয়। এক্ষেত্রে এটা কোয়ালিফিকেশনের সামারি (যোগ্যতার সারাংশ) দিয়ে হতে পারে। যদিও এটি সম্পূর্ণরূপে একটি ঐচ্ছিক বিষয় এবং অনেক প্রথাগত জীবন বৃত্তান্তে এই বিষয়টির উল্লেখই থাকে না। এই সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও বর্ণনাটি আপনার জীবন বৃত্তান্তকে অনেক বেশি শক্তিশালী করতে পারে।
জীবন বৃত্তান্তের “কোয়ালিফিকেশন সামারি” হবে প্রার্থী হিসেবে আপনার যোগ্যতার কুইক সামারি (যোগ্যতার চৌম্বক অংশ)। যেটি দেখলেই আপনার জীবন বৃত্তান্ত পড়ার আগেই নিয়োগ পরিচালনাকারী আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড বা আগের বিষয় সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা এবং চিত্র পায়। এটা কখনই ভুলবেন না যে, ওই একই পদে প্রতিদ্বন্ধিতাকারীদের শত শত জীবন বৃত্তান্তের স্তুপ রয়েছে নিয়োগ পরিচালনাকারীর কাছে। উপরে উল্লেখিত কোয়ালিফিকেশন সামারির মতো আপনার জীবন বৃত্তান্তের একটি শক্তিশালী ও চমৎকার সামারি দিয়ে শুরুর ফলে অন্যান্যদের সাথে আপনার অনেক বড় ব্যবধান গড়ে দিতে পারে।
একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে সচিব (সেক্রেটারি) পদে নিয়োগের জন্য কোয়ালিফিকেশন সামারির উদাহরণ অনেকটা এধরণের হতে পারে: “দক্ষ এবং নির্ভরযোগ্য সেক্রেটারি, ইন্স্যুরেন্স সেক্টরে ব্যাপক অভিজ্ঞতার পাশাপাশি অফিস ব্যবস্থাপনার সব বিষেয়ই দক্ষতা রয়েছে।
নিয়োগ পরিচালনাকারী এটি পড়েই তাৎক্ষণিকভাবে ওই প্রার্থীর প্রতি আগ্রহী হবেন। এমনকি তারা ওই প্রার্থীর পুরো জীবন বৃত্তান্তটিই পড়তে পারেন।
কখনই অস্পষ্ট হবে না : সব সময় সুনির্দিষ্ট এবং সংক্ষিপ্ত হবে
জীবন বৃত্তান্ত লিখতে গিয়ে যখন কেউ বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষাগত অভিজ্ঞতার তালিকা করেন সেখানে অস্পষ্টতা এবং সাধারণ একটি প্রবণতা রয়েছে। যিনি শিক্ষক পদে চাকরির জন্য আবেদন করছেন সেই আবেদনকারীকে এমনটি বিবেচনা করুন যে, তিনি নিম্ন আয়ের স্কুলেও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পাঠদান করেছেন। তাদের অভিজ্ঞতাকে নিম্নোল্লিখিতভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে:
স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক, ঢাকা- বস্তির স্কুলে নিম্ন আয়ের শিশুদের পাঠদান: চ্যালেঞ্জকে জয় করা, উৎকৃষ্ট এবং সংগঠিত কাজ পরিচালনা করতে শিখেছি।
যদি কোন প্রার্থী কোন একটি স্কুল, ফ্যাক্টেরি অথবা অন্য কোন অফিসে কাজ করে থাকেন তাহলে সেক্ষেত্রে তাদের এই কাজের বর্ণনা খুব সামান্যই বলতে পারেন। দুঃখের বিষয় হলো, জীবন বৃত্তান্তে এধরণের অস্পষ্ট লেখা বিশ্বজুড়েই খুবই সাধারণ একটি বিষয়। একজন স্মার্ট নিয়োগ পরিচালনাকারী অভিজ্ঞতার এই বর্ণনা দেখবে এবং চিন্তা করবে “স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজের সময় এই ব্যক্তির বাস্তবে কোন কাজ করেনি এবং আমি নিশ্চিত নয়, তাদের এই কাজের জন্য সঠিক মনোভাব এবং দক্ষতা আছে। ”
অভিজ্ঞতা লেখার সবচেয়ে ভালো ভালো একটি পদ্ধতি হচ্ছে এভাবে লেখা:
স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক, ঢাকা- বস্তির স্কুলে নিম্ন আয়ের শিশুদেরকে গণিত এবং সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়ে পাঠদান: সিলেবাস ডিজাইন এবং পাঠের পরিকল্পনা, পরীক্ষা এবং সাপ্তাহিক বাড়ির কাজের অ্যাসাইনমেন্ট লেখা, শিক্ষার্থীদের সরাসরি পরামর্শ প্রদানের জন্য বার বার সাক্ষাৎ প্রদান করা।
স্কুলে শিক্ষক পদে নিয়োগ পরিচালনাকারী ব্যক্তি এটি পড়ে তাৎক্ষণিকভাবে অনেক বেশি আকৃষ্ট হবেন। এই লেখা থেকে তারা একটি ধারণা পাবে এবং মনে করবে যে, এই আবেদনকারী স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার সময় অনেক গুরুত্বসহকারে এবং ঐকান্তিকতার সাথে কাজ করেছে। তারা জানতে পারবেন যে, একজন ভালো শিক্ষক হওয়ার জন্য যেসব গুণাবলী এবং দক্ষতা থাকা প্রয়োজন তার সব অভিজ্ঞতাই ইতোমধ্যে এই প্রার্থীর মধ্যে রয়েছে। আবেদনকারী কঠোর এবং সিরিয়াস কর্মী হিসেবে পরিচিত হয়।
কখনই মিথ্যা বলবেন না:
অতীতে ইন্টারনেট আসার আসার আগে, যোগ্যতার বিষয়ে জাল করা বা মিথ্যা বলা মানুষের জন্য অনেকটা সম্ভব ছিল। তাদের দেয়া তথ্য-বর্ণনা সঠিক নাকি মিথ্যা তা পরীক্ষা করা বা জানা নিয়োগকারীদের জন্য খুব কঠিন কাজ ছিল। এমনকি ডিউক ইউনিভার্সিটিতে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন, রোডস স্কলার সম্পর্কে তিনি মিথ্যা বলেছিলেন এটা জানার পর তাকে বহিষ্কার করা হয়।
আপনি যদি এই রাস্তা দিয়ে নিচের দিকে যেতে প্রলুব্ধ হন-এমনটি করবেন না। এটা শুধুই অসততা নয়, ইন্টারনেট আবিষ্কারের এই যুগে আপনি খুব দ্রুতই ধরা পড়ে যাবেন। চাকরিদাতা যদি বুঝতে পারে যে, আপনি একজন মিথ্যাবাদী তাহলে আপনি হৃদস্পন্দন হতেই কালোতালিকাভুক্ত হবেন।
গুডলাক!