করোনা মহামারি মোকাবেলায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব
সত্যিই অভূতপূর্ব নভেল করোনাভাইরাসের করাল থাবায় মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানেই থমকে গেছে পুরো বিশ্ব। বৈশ্বিক লকডাউন, অর্থনৈতিক মন্দা এবং ভ্যাকসিন তৈরির প্রচেষ্টার মধ্যে এই ভাইরাস সম্পর্কে উঠে আসছে নিত্য নতুন তথ্য। অবাক করার মতো একটি বিষয় হলো কোভিড-১৯ এর উপসর্গগুলো তুলনামূলকভাবে হালকা বা অনেকের নেই বললেও চলে। ঠিক এই বিষয়টিই এই ভাইরাসটির এত দ্রুততার সাথে ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ। ভাইরাসটি বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে, কিন্তু বেশ চিন্তার ব্যাপার হলো সেই সময়ের মধ্যে এটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে অন্যদের মাঝেও। মৃত্যুর হার কম হলেও, দাবানলের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ায় এটি সবাইকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কোয়ারেন্টাইন বা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকতে বাধ্য করেছে। এখন আমাদের প্রত্যেকের জন্য সঠিক তথ্য সম্পর্কে জানা, নিজেকে এবং চারপাশকে পরিষ্কার রাখার মতো বিষয়গুলো অতীব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে যাতে সময়ের সাথে সাথে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই মহামারি রোধে সক্ষম হয়।
একটি স্বাস্থ্যকর পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস
উপনিবেশীয় জলবায়ুর বদৌলতে পরিবেশগতভাবে আমাদের চারপাশে আছে প্রচুর আর্দ্রতা এবং ধূলিকণা, যা বায়ুবাহিত ভাইরাসগুলোর বৃদ্ধি এবং ছড়িয়ে পড়াকে সহজ করে তোলে। The US National Institutes of Health (NIH) এর এক সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, করোনাভাইরাস কার্ডবোর্ডে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত এবং প্লাস্টিক ও স্টিলের উপর ৭২ ঘন্টা অবধি স্থায়ী হতে পারে। এটি আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহৃত সামগ্রীগুলোর ব্যাপারেও উদ্বেগ সৃষ্টি করে। সবেমাত্র বাইরে থেকে আনা মুদি সামগ্রী, ফোন, গ্যাজেট, রান্নাঘরের বাসন ইত্যাদি আমরা যে কতবার স্পর্শ করি তার কোনো হিসেব আমাদের কাছে নেই। এখানে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো পুরানো অভ্যাসগুলো ঝেড়ে ফেলে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সচেতনভাবে সবকিছু জীবাণুমুক্ত করা। ডিপ ক্লিনিং ছাড়াই নিয়মমাফিক অভ্যাস বজায় রাখাই এখানে মূল উদ্দেশ্য।
ক্লিনিং বা পরিষ্কারের সামগ্রী
এই মহামারিটি অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের সাথে কিছু ভালো অভ্যাসও নিয়ে এসেছে। সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করার মতো সাধারণ কাজটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জাদুকরীভাবে কার্যকর। বাড়ির আশেপাশের জিনিসগুলোর জন্য তরল জীবাণুনাশক নিয়মিত ব্যবহার করলেই হবে। এগুলো আসবাবপত্র এবং অন্যান্য ব্যবহার্য সামগ্রীর উপর ব্যবহার করা যেতে পারে যেখানে ভাইরাসটি বেঁচে থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। ঘর পরিষ্কার করতে আপনি মেঝে এবং কাচ পরিষ্কারের তরল বা ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করতে পারেন। কোনো জিনিস ধরার পর অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার দিয়ে আপনার দুই হাত দ্রুত জীবাণুমুক্ত করে নিতে পারেন। অ্যালকোহল প্যাড দিয়ে বৈদ্যুতিক গ্যাজেটগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা একটি ভালো অভ্যাস।
কী কী পরিষ্কার করতে হবে?
সবকিছুর মধ্যে, মোবাইল ফোনটি দিনে অন্তত একবার অ্যালকোহল প্যাড দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা উচিত। আপনি যদি মোবাইলের জন্য ব্যাক কভার ব্যবহার করেন তবে মোবাইলটি সুইচ অফ করে ব্যাক কভারটি খুলে নিয়ে ফোনের পিছনের অংশ এবং পাশাপাশি ব্যাক কভারটির ভিতরেও পরিষ্কার করে নিন। অ্যালকোহল প্যাডগুলো সাধারণত ৭০% আইসোপ্রোপাইল দ্রবণযুক্ত হয় যা সংবেদনশীল সামগ্রীর ক্ষতি না করেই জীবাণুমুক্ত করার জন্য দুর্দান্ত এবং এটি খুব দ্রুত শুকিয়েও যায়। এই প্যাডগুলো ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, ডিজিটাল ক্যামেরা, কম্পিউটারের যন্ত্রপাতি এবং তার পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো মেকআপ ব্রাশ এবং গয়না পরিষ্কার করার জন্যও দুর্দান্ত। সর্বোপরি, এগুলো স্টেইনলেস স্টিলকে জীবাণুমুক্ত করার জন্য অত্যন্ত কার্যকর, যার উপর প্রায় ৩ দিনের মতো ভাইরাসটি বেঁচে থাকতে সক্ষম (তথ্যসূত্রঃ NIH)।
পরিষ্কার করার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো আপনার মানিব্যাগ। এই সংকট চলাকালীন সময়ে যদিও নগদ টাকা পরিহারের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, তবে আমাদের প্রায়শই এটিএম থেকে নগদ টাকা উত্তোলন, নগদ অর্থ আদান-প্রদান করা, কেনাকাটার সময় খুচরা করা বা পণ্য হোম ডেলিভারি নেওয়ার সময়েও প্রয়োজন হয়। কাগজের টাকা হচ্ছে এক কথায় জীবাণুর ভাণ্ডার এবং এগুলো হাতবদলের মাধ্যমে খুব দ্রুত ব্যাকটিরিয়া এবং ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়। নগদ টাকা বিনষ্ট না করে পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত করার কোনো প্রমাণিত উপায় না থাকলেও ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য মানিব্যাগ এবং পার্সের অভ্যন্তরটি ভালোভাবে পরিষ্কার করা উচিত।
সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী, বাড়ির চারপাশে আমাদের প্রতিনিয়ত স্পর্শ করা জিনিসগুলো বেশি বেশি পরিষ্কার রাখা জরুরি। এই তালিকার প্রথম সারিতেই রয়েছে চাবি এবং দরজার হাতল। এছাড়াও সুইচ, কল, মাইক্রোওয়েভের হাতল ও এর বাটন, ফ্রিজ এবং ক্যাবিনেট ইত্যাদি তো আছেই। গহনা এবং ফ্যাশন আইটেমগুলো, পাশাপাশি প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত ব্যাগ এবং জুতা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। তাছাড়া আপনার বাইরে পরার জুতা কোনো অবস্থাতেই ঘরের ভেতরে আনা নিরাপদ নয়। তবে আপনি যদি খুব একটা বাহিরে আসা যাওয়া না করে থাকেন এবং আপনার বাড়ির কেউ যদি ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত না হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আপনি আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসাদি যেমন পরিধেয় পোশাকটি সাধারণ সময়ের মতই পরিষ্কার করতে পারেন। তবে আপনি যদি বাজার করতে, ওষুধ কেনার জন্য অথবা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাহিরে বের হন, সেক্ষেত্রে আপনার জামাকাপড় এবং অন্যান্য জিনিসপত্র সাথে সাথে পরিষ্কার করুন। এমনকি বিছানার চাদর ও কভার নিয়মিতভাবে পরিষ্কার রাখাটাই নিরাপদ। এই ভাইরাসটি বেশ কয়েক ঘন্টা বা একদিন পর্যন্ত পোশাকের উপরে বেঁচে থাকে বলে জানা গেছে। তবে যেকোনো ধরণের ডিটারজেন্ট এই ভাইরাসটিকে নির্মূল করার জন্য যথেষ্ট।
যদি আপনার কোনো গাড়ি বা মোটরবাইক থেকে থাকে এবং খুব জরুরি কোনো কাজের জন্য ব্যবহার করে থাকেন সেক্ষেত্রে অবশ্যই তা ভালোভাবে ধুয়ে রাখুন। এছাড়া গাড়ির অভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিন। স্টিয়ারিং হুইল, গিয়ার শিফট, ডোর, ড্যাশবোর্ড, সিট, ডোর হ্যান্ডেল, সিট বেল্টগুলো একটি ভেজা কাপড় দিয়ে অল্প পরিমাণে সাবান ব্যবহার করে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে ভুলবেন না। তবে এক্ষেত্রে অ্যালকোহল বা ব্লিচিং এজেন্ট দিয়ে পরিষ্কার করা থেকে বিরত থাকুন, কারণ তা লেদারটিকে শুকিয়ে ফেলবে, যার ফলে ফাটল এবং বিবর্ণ হয়ে যেতে পারে। মোটরবাইকের ক্ষেত্রে ঠান্ডা পানি ব্যবহার করুন এবং বাইকের বডি পরিষ্কার করার জন্য হালকা সাবান, ডিটারজেন্ট বা শ্যাম্পু ব্যবহার করুন এবং যে সকল স্থানে হাত পৌঁছায় না সে সকল স্থানের জন্য ব্রাশ ব্যবহার করুন।
কীভাবে নিরাপদে বাহিরে বের হবেন?
যদিও বাড়িতেই থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু খুব বেশি প্রয়োজনে আমাদের বাহিরে যেতে হতে পারে। তাই বাহিরে যাওয়ার সময় সাবধানতা অবলম্বন আমাদের এই সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত করবে। এখানে কয়েকটি সুরক্ষা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা হলোঃ
- সর্বদা একটি মাস্ক এবং গ্লাভস পরিধান করুন এবং বাইরে থাকাকালিন পুরো সময় পরে থাকুন।
- কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় সর্বদা টিস্যু ব্যবহার করুন, ব্যবহারের পর তা একটি ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিনে ফেলে দিন।
- আপনার সাথে যদি টিস্যু না থাকে সেক্ষেত্রে কাশি বা হাঁচি দেয়ার সময় অবশ্যই কনুই দিয়ে মুখ ঢেকে নিন।
- পকেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা অ্যালকোহলযুক্ত ওয়াইপ বহন করুন এবং স্পর্শ করা জিনিসগুলো জীবাণুমুক্ত করতে ব্যবহার করুন।
- লম্বা চুল থাকলে তা বেঁধে রাখুন।
- নেকলেস, কানের দুল ইত্যাদি অলঙ্কার পরিহার করুন।
- অপরিষ্কার হাতে আপনার মুখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।
- যতটা সম্ভব নগদ টাকা পয়সার লেনদেন এড়িয়ে চলুন। পরিবর্তে অনলাইন বা মোবাইল পেমেন্ট করুন।
- যদি একান্ত নগদ টাকা পয়সার লেনদেন করে থাকেন তবে অবিলম্বে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে নিন।
- অন্যদের থেকে কমপক্ষে ৩ ফুট বা ১ মিটার দূরত্ব বজায় রাখুন, বিশেষত মুদি দোকানগুলোর বাইরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ান।
উপরোক্ত পরামর্শগুলো সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে বেশ কার্যকর। বিশেষত বাহির থেকে বাড়ি ফেরার সময় অতিরিক্ত সচেতনতা অবলম্বন করুন। এছাড়াও বাড়িতে প্রবেশের পূর্বে যে সকল কাজগুলো আমাদের করা উচিতঃ
- ঘরের বাইরে জুতা রাখুন।
- মাস্ক এবং গ্লাভস দ্বিতীয়বার ব্যবহারের কোনো অর্থ নেই, তাই এগুলো ব্যবহারের পর একটি ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিনে ফেলে দিন।
- কোনো কিছু স্পর্শ করার আগে হাত ভালভাবে ধুয়ে ফেলুন।
- চাবি, ওয়ালেট এবং মোবাইল ফোন সহ আপনি বাইরে যে সকল জিনিস বহন করেছিলেন তা জীবাণুমুক্ত করুন।
- আপনার জামাকাপড় পরিবর্তন করুন, না ধুয়ে ফেলা পর্যন্ত এগুলো আবার বাড়িতে পরবেন না।
- গরম পানি এবং জীবাণুনাশক সাবান দিয়ে গোসল করুন।
সর্বশেষ ভাবনা
আমাদের এখনও মনে রাখা উচিত যে সবকিছু সম্পূর্ণরূপে জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব নয় এবং আমরা যাই করি না কেন অল্প পরিমাণে হলেও ঝুঁকি থাকবেই। মূল উদ্দেশ্য হলো যথাসম্ভব ঝুঁকি কমিয়ে আনা। যেহেতু আমরা একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি একরকম বিচ্ছিন্নতার মধ্যে থেকে দিন কাটাচ্ছি, সর্বোপরি সবকিছু সাবধানে পরিষ্কার করার জন্য উপরের পদক্ষেপগুলো নেওয়ার সময় আমাদের ভয় বা আতংকিত হওয়া উচিত নয়। এর পরিবর্তে আমাদের স্বাভাবিক পরিষ্কারের রুটিনে এই অনুশীলনগুলো যোগ করে নেওয়া উচিত, কারণ এগুলো সাধারণত বা মহামারি পরিস্থিতি – উভয় ক্ষেত্রেই ভালো অভ্যাস। এই পরিস্থিতিতে এটি খুবই জরুরি যে আমরা সুস্থ ও পরিষ্কার থাকি, আমাদের পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে পারি, আমাদের কোয়ারেন্টাইনের সময়কে কাজে লাগাতে পারি এবং একে অপরকে সমর্থনের মাধ্যমে এই সংকটে একসাথে লড়াই করি।
আপনার এলাকার সুপার স্টোরগুলো থেকে ঘরে বসেই খাদ্যসামগ্রী, ঔষধ ইত্যাদি বুঝে নেওয়ার জন্য ভিজিট করুন Bikroy এর নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। আমাদের ২০০ এরও বেশি রেজিস্টার্ড মেম্বারদের পোস্ট করা ৭,৫০০ এরও বেশি বিজ্ঞাপনের মধ্যে রয়েছে খাবার সামগ্রী যেমন চাল, ডাল, তেল, ডিম ইত্যাদি, মাস্ক, গ্লাভস, হ্যান্ডওয়াশ, স্যানিটাইজারের মতো স্বাস্থ্যসেবার পণ্য, ঘর পরিষ্কারের জন্য গৃহস্থালি সামগ্রী, শিশুদের পণ্য যেমন দুধ, ফর্মুলা ডায়াপার ইত্যাদি, তাজা ফল ও সবজি, টাটকা মাছ ও মাংস ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলো।