ম্যাকবুক ভার্সেস আইপ্যাড প্রো : কোনটি সবচেয়ে ভালো কার্যক্ষমতাসম্পন্ন মেশিন?
আজকের প্রযুক্তিনির্ভর দুনিয়ায় অ্যাপল এক আভিজাত্যের প্রতীক। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মার্কিন এ ব্র্যান্ডটি বাজারে আনছে নিত্যনতুন পণ্য। অ্যাপেলের আইপ্যাড প্রো মূলত ল্যাপটপের রিপ্লেসম্যান্ট (বিকল্প) হিসেবে বাজারজাত হয়েছে এবং সৃজনশীল ডিজাইনারদের জন্য এটি একটি স্বর্গীয় যন্ত্র হিসেবেই চালু হয়েছে। একইভাবে তাদের ম্যাকবুক পণ্যটিকে সুপার পোর্টেবল ল্যাপটপ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কারণ আপনি সব ধরণের কাজের জন্য যেমন সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং ভালো পণ্যটি খুঁজছেন এই ম্যাকবুক সুপার পোর্টেবল ল্যাপটপটিতে আপনার প্রয়োজনীয় সব কাজই করা যাবে। তাই আমরা এই দুটি পণ্যকে (আইপ্যাড প্রো ও ম্যাকবুক) একই ছাদের নিচে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং একটিকে অন্যটির বিপরীতে একটি গ্ল্যাডিয়েটর ম্যাচে প্রতিযোগিতায় রাখছি। এটি দেখার জন্য যে এই দুটি পণ্যের মধ্যে কোন পণ্যটি সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বা শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এই আর্টিকেলটির লক্ষ্যই হচ্ছে এটি দেখা যে, ল্যাপটপ যেমন প্রোডাকটিভ (কার্যক্ষমতা সম্পন্ন) তেমন প্রোডাকটিভ হিসেবে সত্যিই কি আইপ্যাড প্রো ল্যাপটপের স্থানটি দখল করতে পারবে।
ফর্ম ফ্যাক্টর এবং টাইপিং
যখন সাধারণ ব্যবহারকারীরা ল্যাপটপের কার্যক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করেন, তখন সাধারণত টাইপিংয়ের বিষয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়। আমরা নতুন ডিভাইসে এই বিষয়ের আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত করবো। ওল্ড স্কুল ল্যাপটপের কীবোর্ড+টেবলেট ম্যাকবুকে খুব কমই স্থাপন করা হয়েছে। এর স্মার্ট কীবোর্ডের কী গুলোতে ব্যাকলিট (কী এর পেছনে আলো) নাই এবং ফ্যাব্রিকস এর কভার কী গুলোকে করেছে কিছুটা কম সংবেদনশীল। ডিভাইসটিতে কোন ট্র্যাকপ্যাড অথবা কব্জির বিশ্রামের সুযোগ নেই এবং এতে ব্যবহৃত প্রকৃত কী গুলো স্ক্রীনের খুব কাছাকাছি। একারণে আপনি যখন এটি আপনার কোলে নিয়ে ব্যবহার করবেন তখন আপনার কাছে এটি ব্যবহার করতে অপরিচিত, বেখাপ্পা এবং পরিবর্তিত মনে হবে। টেবলেট শুধু খাড়া ভাবেই ব্যবহার করতে হয়। একটি অ্যাঙ্গেলে ব্যবহারের সুযোগ থাকায় এটি মাঝে মধ্যে অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া অ্যাপল পেনসিল বিড়ম্বনার একটি কারণ হতে পারে। কারণ আপনি যদি ব্যাগ বহন না করেন তা হলে অ্যাপল পেনসিলটি রাখার মতো কোন স্থান বা জায়গা নেই। যেখানে এটিকে রেখে আপনি বহন করতে পারবেন। যদিও ম্যাকবুকের কী গুলো খুব বেশি গভীরে রাখা হয়নি (আলগা ভাবে স্থাপন করা হয়েছে)। প্রচলিত ডিভাইসগুলোর উপকরণ যেভাবে সংগঠিত করে তৈরি করা হয়েছে এবং এসবের কার্যকারিতা থেকে ম্যাকবুক কিছুটা ভিন্ন। কারণ ম্যাকবুকের স্ক্রীনটির অ্যাঙ্গেল পরিবর্তন করা যায়। আর এই বিষয়টি ম্যাকবুকে এনেছে গুরুত্বপূর্ণ ভিন্নতা এবং ব্যবহারে করেছে দারুন আরামদায়ক।
অপারেটিং সিস্টেম এবং শক্তিশালী কার্যক্ষমতা
কোন অপারেটিং সিস্টেমটি আপনার জন্য আদর্শ এবং আপনার কাজের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী তা পুরোপুরি নির্ভর করে আপনার উপরেই। যদিও ম্যাকবুকে ব্যবহারকরা অপারেটিং সিস্টেম এক্স (ওএসএক্স) সঠিক ডেস্কটপ সলুউশন। অ্যাপেলের অপারেটিং সিস্টেমটি (আইওএস) মূলত মোবাইলেরই অনুরূপ, যার অভিজ্ঞতা আপনি ইতোপূর্বেআইফোন এবং আইপ্যাডে পেয়েছেন। আইফোন অপারেটিং সিস্টেমে বিচিত্র সব অ্যাপ নির্বাচনের কারণে মনে হতে পারে যে আইফোন এবং আইপ্যাডের সাথে এর তুলনাটাএকটি কৌশল।আপনি আপনার প্রয়োজনীয় ওয়ার্ড প্রসেসিং এবং ইন্টারনেট সার্ফিং অত্যন্ত সাবলীলভাবে এই ডিভাইসে করতে পারেন। কিন্তু যখন ছবি এবং ভিডিও এডিটিংএর মতো জটিল কাজ করতে যাবেন তখন ম্যাকবুক খুব সুন্দর কাজ করবে কারণ এতে রয়েছে পরিশীলিত এবং নির্ভরযোগ্য সফটওয়্যার।
ল্যাপটপকে সাধারণত প্রোডাকটিভ (কাজ করার জন্য) টুলস হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। পক্ষান্তরে ট্যাবলেটকে প্রধানত মিডিয়া কনজাম্পশন (যোগাযোগ এবং বিনোদন এর জন্য) টুলস হিসেবে মনে করা হয়। যদিও কীবোর্ড, অ্যাপল পেনসিল এবং স্পøাইট স্ক্রীন মুড আইপ্যাডে প্রকৃত উপযোগিতা যোগ করেছে। স্পøাইট স্ক্রীনের কারণে ডিভাইসটিতে আপনি যেকোন ধরণের মাল্টিটাস্কিং কাজ করতে পারবেন না। কারণ স্পøাইট স্ক্রীনটিকে স্বল্পকিছু অ্যাপলিকেশন্সের জন্য সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ম্যাকবুকে ব্যবহার করা অপারেটিং সিস্টেম এক্স প্রকৃতপক্ষে ডেস্কটপে ব্যবহার করা অপারেটিং সিস্টেমের মতোই। প্রতিদিন কাজের জন্য যেসকল ফিচার মিলিয়ন মিলিয়ন বার ব্যবহার হয় এধরণের সকল ফিচারই এই ম্যাকবুক ডিভাইসটিতে ব্যবহার করা যাবে। অপারেটিং সিস্টেম এক্স কাজ এবং প্রোডাক্টিভিটির জন্য গ্রাউন্ড আপ (ভিত্তি মূল) থেকে তৈরি করা হয়েছে। যেখানে আইফোন অপারেটিং সিস্টেমে কাজ এবং প্রোডাক্টিভিটি দ্বিতীয় স্তরের। আইপ্যাডকে ডিভাইসটিকে সত্যিকার অর্থে ওয়ার্কহর্সে পরিণত করতে চাইলে আইপ্যাড প্রো তে অবশ্যই তাদের অপারেটিং সিস্টেম গুরুত্বের সাথে পুনঃডিজাইন করতে হবে।
আইপ্যাডের এই সেগমেন্ট বা বিভাগের কফিনে চুড়ান্ত পেরেক হচ্ছে আইপ্যাডের সিঙ্গল লাইটনিং পোর্ট। লাইটেনিংয়ের সংযোগের জন্য বাজারে প্রচুর জিনিসপত্র (পোর্ট সংক্রান্ত যন্ত্রাংশ) রয়েছে। কিন্তু বাজারের এসব পোর্ট আইপ্যাডের জন্য মানসম্মত নয় এবং খাপ খায় না। অন্যদিকে ম্যাকবুকেও একটি সিঙ্গেল ইউএসবি টাইপ সি পোর্ট আছে। এই পোর্টটি খুব দ্রুতই বিদ্যমান মাইক্রো ইউএসবি, ইউএসবি-এ এবং ইউএসবি-বি স্টান্ডার্ড পোর্টের রিপ্লেস করা যায়। এই ইউএসবি সি পোর্টটি ব্যবহার করে হাব নেটওয়ার্কের সাথেও সংযোগ দেয়া যাবে। এটি আপনাকে ইনপুট এবং আউটপুটের সকল ফর্মে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেবে। একারণে ম্যাকবুকের ভার্সেটাইল মানের পোর্টটির সাথে আইফোন/আইপ্যাডের বিশেষ লাইটনিং পোর্টটির কোন তুলনা হতে পারে না।
মিডিয়া কনজাম্পশন
আইপ্যাড হচ্ছে মিডিয়া কনজাম্পশনের (যোগাযোগ ও বিনোদন) ক্ষেত্রে কিং বা সবার সেরা এবং সত্যিই এক্ষেত্রে আইপ্যাডকে এই উপাধি দেয়াই যায়। এর সাথে থাকা স্পিকার এবং বড় স্ক্রীন আইপ্যাডকে গ্রাহকদের স্বপ্নের পণ্যে পরিণত করেছে। ট্যাবলেট এবং ট্রাম্পে ব্যবহৃত স্পিকারের সাউন্ড সত্যিই অসাধারণ এবং অবিশ্বাস্য। আর এর সবই ম্যাকবুকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এর সাথে বোনাস হিসেবে সংযুক্ত করা হয়েছে টাচ স্ক্রীন। টাচ স্ক্রীনের কারণে ডিভাইসটিকে আলাপচারিতা এবং কনটেন্ট ব্যবহারে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্য করেছে। একই সাথে ডিভাইসটিকে করেছে কম ক্লাঙ্কি বা বেঢপ (যখন স্মার্ট কীবোর্ড রিমুভ কা হয়)। ডিভাইসটিতে কনটেন্ট কনজিউমিংয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন হয় তা আইপ্যাডের চেয়ে ভালো। অ্যাপ স্টোর থেকে রিচ অ্যাপ সিলেকশন পদ্ধতির জন্য ম্যাকবুকের সাথে অন্য ডিভাইসগুলো প্রতিদ্বন্ধিতা করতে পারবে না।
ব্যাঙ ফর ইউর বাক
২০১৫ সালে ম্যাকবুকের খুচরা মূল্য ছিল ১,২৪,০০০/= (এক লক্ষ ২৪ হাজার টাকা) এবং ১২.৯ ইঞ্চির আইপ্যাড প্রো এর খুচরা মূল্য ছিল ১,১২,০০০/= (এক লক্ষ ১২ হাজার টাকা)। যাহোক মূল্যের ক্ষেত্রে আইপ্যাডকে আসলেই ম্যাকবুকের সাথে তুলনা করা যায়। তবে ম্যাকবুকে স্মার্ট কী বোর্ডের খরচটি একটি বড় ফ্যাক্টর। এর কারণে ডিভাইসটির মূল্য আইপ্যাডের চেয়ে কিছুটা বেশি। তবে কীবোর্ডটি হিসেব করলে অনেক কম। কারণ এই কীবোর্ডটিতেই শুধু অতিরিক্ত ২১,৫০০/= (২১ হাজার ৫০০ টাকা) ব্যয় হয়েছে। এর ফলে হিসেব করলে দেখা যাবে আইপ্যাডের ক্ষেত্রে আগের মূল্যের সাথে পরিবর্তিত হয়ে সর্বমোট মূল্য দাঁড়িয়েছে ১,৩৩,৫০০/= (এক লক্ষ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা)। অন্যদিকে কীবোর্ডসহ ম্যাকবুকের মূল্য এক লক্ষ ২৪ হাজার টাকা। প্রতিদিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে ডিভাইসটির অ্যাপল পেনসিল আসলে তেমন অতি প্রয়োজনীয় কোন যন্ত্রাংশ নয়। কিন্তু এটি যদি আপনি নিতে চান তাহলে এর জন্য আপনাকে ১২,৫০০/= (১২ হাজার ৫০০ টাকা) মূল্য পরিশোধ করতে হবে। কর্মজীবী মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, ম্যাকবুক ডিভাইসটি ফ্যাক্টর এবং অপারেটিং সিস্টেমে যাচাই-বাছাই এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে পণ্যটি অনেক ভালো মানের হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অন্যদিকে বর্তমান সময়ে প্রত্যেকেই ডিভাইসের মাধ্যমে মিডিয়া কনজাম্পশন বা বিনোদন, ক্যাজ্যুয়াল গেমিং এবং ওয়ার্ড প্রোসেসিংয়ের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে চায়। আর এর সবই পাওয়া আইপ্যাড প্রো তে স্বল্পমূল্যে।
ডিভাইস দুটির সারমর্ম:
আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ডিভাইসটিকে প্রতিযোগিতায় রাখা। অ্যাপল যেভাবে দাবি করছিল তারা কি পারবে তাদেরই তৈরি একটি ল্যাপটপের বিপরীতে ল্যাপটপের রিপ্লেস হিসেবে ডিভাইসটির স্থান দখল করতে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে কিভাবে একটি অন্যটির বিপরীতে কাজ করে। আমাদের কাছে এর উত্তর অত্যন্ত পরিষ্কার। আইপ্যাড প্রো যেখানে অনেক রিচ এবং হাই কোয়ালিটির অভিজ্ঞতা অফার করছে। যদি তাদের অপারেটিং সিস্টেম দেখি, দেখা যাবে, কাজ করার সময় আইফোন প্রো ডিভাইসটি ওকেশনাল ইমেইল অথবা ওয়ার্ড ডকুমেন্টের জন্য সঠিক ডিভাইস মনে হয় না। গুরুত্বপূর্ণ এবং মাল্টিটাস্কিং কাজের ক্ষেত্রে ডিভাইসটিতে বিশেষভাবে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আইফোন অপারেটিং সিস্টেম এর বিপরীতে অপারেটিং সিস্টেম এক্স কে শক্তিশালী অপারেটিং ভার্সন হিসেবে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে, আইপ্যাড প্রো ম্যাকবুককে অনেক দিক দিয়ে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু ল্যাপটপ হিসেবে এটি এখনো তেমন গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করতে পারেনি। একটি ডিভাইস থেকে আপনি যা প্রত্যাশা করেন তার সবকিছ্রু জন্য আপনি ট্যাবলেটের উপর নির্ভর করতে পারেন। আর আপনি যদি চান তাহলে তর্কসাপেক্ষে দেখিয়ে দেয়া যাবে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে ভালো ট্যাবলেট কোনটি? আপনার এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই আইপ্যাড প্রো। কিন্তু আপনি যদি ল্যাপটপের কথা বলেন বা ল্যাপটপ নিতে চান তাহলে আপনার জন্য সবচেয়ে ভালো অপশন হচ্ছে ম্যাকবুক।