উড়ন্ত কবুতর, বাংলাদেশীদের শখের প্রতিযোগিতা
পোষা পাখি কবুতর। কিছুটা ঘুঘুর মত দেখতে। শরীরটা একটু স্থুল, ছোট ঘাড়, তীক্ষ্ণ ধারালো ঠোঁট, নখরা পায়ের পাতা। এই পাখিটাকে সবাই চেনেন। এদের ওজন মোটামুটি ৭ আউন্স থেকে শুরু করে তিন পাউন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে। বেঁচে থাকে প্রায় পনের বছরের মত। কোন কোন প্রজাতির কবুতর আবার ত্রিশ বছরেরও বেশি বাঁচে। কবুতরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো তার ডানা। মোটামুটি এক ফুট বা বারো ইঞ্চি থেকে সাড়ে তিন ফুট পর্যন্তও হয়ে থাকে। এই ডানা কবুতরের উড়ে যাওয়া অনন্য করে তোলে। ডানা ঝাঁপটিয়ে আকাশে এক ঝাঁক কবুতর! পাখি ভালো না বাসলেও চোখ চলে যাবে সেদিকে। আর যখন কবুতর গুলোর মধ্যে ওড়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয় তখন ফুটে ওঠে কবুতেরর ডানার আসল সৌন্দর্য। ধারণা করুন তো একটা কবুতর ঘন্টায় কত বেগে উড়ে যেতে পারে! অন্তত ৪০ থেকে ৫০ মাইল প্রতি ঘন্টায়। আর একদিনে কবুতর প্রায় ৬০০ মাইল পর্যন্ত উড়তে পারে। এ জন্যই বোধ হয় আগের যুগের রাজা বাদশারা চিঠি আদান প্রদানের জন্য কবুতরের উপর নির্ভর করতো!
পিজিয়ন রেসিং বা কবুতের ওড়ার প্রতিযোগিতা বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বেশ মজার প্রতিযোগিতা এটা। আপনার কবুতরটাকে আকাশে মুক্ত করে দিন। নির্দিষ্ট একটি দুরত্ব থাকবে। কবুতরটি উড়ে যাবে আর আসবে। একটি নির্দিষ্ট সময়ে পাখিটি কতবার ঐ দুরত্ব অতিক্রম করবে তার উপর হবে জয় পরাজয়। যত কম সময় এবং যত বেশিবার ঐ দুরত্ব অতিক্রম করা- সেখানেই কবুতরের জন্য জয়ের মুকুট। আপনার কবুতর মানে মুকুটটি কিন্তু আপনারও।
সাধারণত হোমার নামে এক ধরনের কবুতর এই পিজিয়ন রেসিং এ ব্যবহার করা হয়। এই হোমার কিস্তু গ্রীক সাহিত্যের মহাকবি নয়! এই কবুতরকে হোমার বলা হয় তার পেছনে মজার এক কারণ রয়েছে। ইংরেজি শব্দ হোম থেকে এসেছে এই হোমার শব্দটি। এই ধরনের কবুতর অনায়াসে অনেক দুর থেকে ঠিক ঠিক পথ চিনে ঘরে ফিরে আসতে পারে। টেক মি হোম- হাজার মাইল দুরে গিয়েও সে নিজেই ফিরে আসতে পারে ঘরে। এই শহরের কানা গলি থেকে আমরা পথ হারাই আর হোমার ফিরে আসে ছোট্ট নীড়ে! আরও দেখে নিতে পারেন কবুতর পালনের ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ।
ওড়ানোর জন্য কবুতরগুলোকে বিশেষ অনুশীলনের আওতায় আনতে হয়। এই প্রশিক্ষণের লক্ষ্য কবুতরগুলো যেন উড়ে যেতে পারে বহুদুর আর তা খুব অল্প সময়ে। এই প্রশিক্ষণের জন্য এখন অনেক কৌশল এবং সময় নিরুপণের জন্য বিশেষ যন্ত্রও পাওয়া যায়। তবে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে কবুতরের বিশেষ থাকার জায়গা। এটা আপনার উপর নির্ভর করে যে আপনি কোথায় এবং কতগুলো কবুতর এক সাথে রাখছেন। এই থাকার জায়গার প্রশস্ততা এবং সুবিধার উপরই কবুতরগুলোর ভবিষ্যতে ওড়ার ক্ষমতা অনেকখানি নির্ভর করে। এখানেই পাখিগুলো তাদের দ্রুত ওড়ার কৌশল শেখে। এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পশুপাখি লালনপালন করার টিপস গুলোন দেখুন।
কবুতরের থাকার জন্য যে খাঁচা ব্যবহার করবেন সেটা একটু খোলামেলা পরিবেশে থাকা উচিত যাতে পাখিগুলো পর্যাপ্ত আলো বাতাস পায়। পাখিগুলোকে উন্নতমানের খাবার, শস্য দানা এবং ছোট ছোট ইট/ পাথরের টুকরা খেতে দিন। খেয়াল রাখবেন যাতে খোপ/ খাঁচা গুলোতে পর্যাপ্ত পানি থাকে। পাখিগুলোর জন্য ক্যালসিয়াম এবং খনিজ খাদ্যের খুবই প্রয়োজন। এজন্য তাদেরকে বার্লি, কর্ন, মিলেট, গম, শীমের বা অন্যান্য শস্যের বীজ দিতে পারেন। তবে বাজারে এখন প্যাকেটজাত খাবার পাওয়া যায়। সেগুলোও দিতে পারেন।
যেসব কবুতর ওড়ার প্রতিযোগিতায় যায় সেগুলো দেখতে কেমন? আসলেই একটু রাজকীয় ধরণের। বিশেষ করে এগুলোর পাখনার জন্য। দেখুন পাখিটার পাখনা বা ডানা যেন বেশ সিল্কি হয়। শরীরটা হতে হবে বেশ শক্ত এবং পেশীবহুল। খোপ বা খাঁচা থেকেই প্রধানত ওড়ার প্রশিক্ষন শুরু হয়। এখান থেকেই তাদের পেশী গঠনের জন্য এবং শক্ত- সামর্থ বানাবার আসল অনুশীলন করিয়ে দেয়া দরকার। একেবারে ছোট থেকেই আস্তে আস্তে ওড়ানোর কাজ শুরু করে দিন। প্রথমদিকে কবুতরের পাখা ধরে কিছুটা উপরে নিয়ে ছেড়ে দিন। একটু একটু করে উড়তে শিখলে এবার থাকার জায়গা থেকে কিছুটা দুরে নিয়ে উপর থেকে ছেড়ে দিন। এভাবে আস্তে আস্তে ওড়ার ক্ষমতার পাশাপাশি দুরে উড়ে যাওয়া এবং ঘরে ফিরে আসার অনুশীলন হয়ে যাবে।
এবার একটু ভিন্ন অনুশীলন করুন। কবুতরটির জন্য কিছু পুরস্কারের ব্যবস্থা করুন। কবুতরেরর খাঁচাটির মধ্যে আগে শুরু করুন। যখন একটু দুর থেকে দ্রুত উড়ে আসবে তখন বিশেষ কিছু খাবার, যা সব সময় দেন না, সেরকম কিছু দিয়ে রাখুন। কবুতরটিকে একটু দুরে নিয়ে যান। তার আগেই খাচার বাইরে তার স্পেশাল ট্রিট রেখে দিন। একটু দুরে নিয়ে কবুতরটিকে ছেড়ে দিন। দেখুন সে কত স্বল্প সময়ে ফিরে আসছে। আস্তে আস্তে দুরত্ব বাড়িয়ে দিন। এক মাইল বা দু মাইল কর্ওে বাড়াতে পারেন। মাঝে মাঝে আরেক জনের সাহায্য নিতে পারেন। একজন দুর থেকে কবুতরটাকে ছেড়ে দিতে পারেন। আর আপনি খাচা বা খোপের এখানে থেকে কবুতরটির ওড়ার সময় নিরুপণ করতে পারেন। এই অনুশীলণ নিয়মিত করুন যাতে আপনার পাখিটা ওড়ার প্রতিযোগিতার জন্য পুর্ণভাবে প্রস্তুত হয়ে যায়।
কবুতর ওড়ানোর শখ মানুষের বেশ পুরনো। খ্রিষ্টপুর্ব ২২০ এর আগে বেলজিয়ামে কবুতর ওড়ানোর প্রতিযোগিতার ইতিহাস পাওয়া যায়। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে এখন এটা অনেক জনপ্রিয়। তবে এই শখ সবার জন্য নয়। কিন্তু পশু বা প্রাণীর প্রতি যাদের সহজাত ভালোবাসা রয়েছে তারা এটা খুব উপভোগ করতে পারবেন। বলা যেতে পারে কবুতর ওড়ানোর প্রতিযোগিতা পুরো মাত্রার আনন্দদায়ক খেলা। শখের তোলা আশি টাকা- কবুতর ওড়ানোর জন্য কথাটা বলা যেতেই পারে। তবে হ্যাঁ, এরজন্য আপনার দুটো বিষয় পুরোপুরি জানতে হবে। একটা হলো কবুতরের যতœ নেয়া আরেকটা হলো কবুতরকে ওড়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষন দিতে পারার ক্ষমতা। এভাবেই এই শখের খেলায় আপনি পুর্ণ আনন্দ পেতে পারেন।
কোথায় পাবেন কবুতর?
ভালো কবুতর কোথায় পাবেন আশেপাশে? এখন অবশ্য চাইলেই সহজে কবুতেরর খবর নিতে পারবেন। কোন কবুতরের জাত কতক্ষণ উড়তে পারে, প্রাণশক্তি কেমন এসব দরকারি তথ্য এখন সহজেই পেতে পারেন। বাংলাদেশে ক্লাসিফায়েড সাইটগুলো এজন্য সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে। দেখে নিতে পারেন Bikroy.com। বিভিন্ন জাতের কবুতর এবং দামের তারতম্য পাবেন এখানে। বিশেষ করে ওড়ার প্রতিযোগিতায় যেসব কবুতর ব্যবহৃত হয় সেগুলো এখানে পাবেন। কি কবুতর কিনবেন? আর ভাল স্টক কিভাবে পাবেন? এজন্য যারা কবুতর পালন করে থাকেন তাদরে সাথেও কথা বলে নিলে ভালো হয়। মোট কথা ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে তারপর কোন পাখিটা কিনছেন সে সিদ্ধান্ত নিন।
কবুতর কেনার সিদ্ধান্ত তো নেয়া হলো। এবার ভালো খাঁচা বা খোপের ব্যবস্থা করুন। এটাই কিন্তু আপনার পাখির বাসস্থান। ভালো খাবারের পাশাপাশি সেখানে পানির ব্যবস্থা থাকতে হবে। খাঁচার ভিতর একটা আড়াআড়ি বসার ব্যবস্থাও রাখুন, ঠিক যেভাবে গাছের ডালে পাখি বসে এরকম ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আসল কথা হলো খোপটা যেন প্রশস্ত হয় আর পাখিগুলোর থাকার কোন অসুবিধা না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখবেন বাংলাদেশে কবুতররে জন্য পরিবেশটা একটু কঠিন। বিশেষ করে তাদের প্রতিপালনের জন্য ভালো পরিবেশের অভাব। তাছাড়া অনেকে কবুতর ধরে আটকে রাখে। আবার অনেকে মনে করে কবুতর মলের মাধ্যমে অনেক সময় রোগ ছড়ায় আপনার পাখিটাকে ভালোবাসুন। ও আপনার আনন্দের খোরাক। ভালোভাবে প্রতিপালন করুন।
বাংলাদেশের মত জায়গায় যেখানে শহরে থাকার জায়গা অনেকখানি সীমিত; সেখানে কবুতরের থাকার জন্য আপনার বিশেষ পরিকল্পনার দরকার। এমনভাবে খাঁচা বা খোপটা বানান যেখান থেকে পাখিগুলো ওড়ার জন্য জায়ড়া পায়, কাছাকাছি উড়ে আবার ফিরে আসতে পারে। তবে বাংলাদেশে যে কবুতর ওড়ানোর শখ বেশ পুরনো তা এই শখের মানুষদের কাছ থেকেই জানা যায়। এখনো কবুতরের বিশেষ মার্কেট রয়েছে এখানে। গিরিবাজ কবুতরটি ওড়ানোর খেলার জন্য বেশ বিখ্যাত। কবুতর ওড়ানোকে যারা শখ হিসেবে নিয়েছেন তারা এখন চান এটাকে আরো বেশি জনপ্রিয় করে তুলতে।
একটা কথা মনে রাখা জরুরী। শুধুই কি বাজার থেকে বা বিক্রয় ডটকম থেকে কবুতর কিনবেন? একটু খেয়াল করলে আপনার কবুতরের সংখ্যা নিজেই বাড়াতে পারেন। কবুতরের প্রজনন সম্পর্কে একটু জেনে নিন। সাধারণত ছয় মাসের বেশি বয়স হলে কবুতর ডিম পাড়ে। এসময় তাকে খাঁচায় রাখা নিশ্চিত করা জরুরী। আবার একটানা কতবার কবুতরটিকে প্রজনন করাবেন তা আপনাকেই ঠিক করতে হবে। এজন্য পুরুষ ও স্ত্রী কবুতরকে আলাদা রাখতে পারেন। আবার খাঁচার মধ্যে কাঠের ডিম রেখে দিতে পারেন। তাতে মা কবুতর মনে করবে যে তার এখনও ছোট বাচ্চা রয়েছে। কবুতরের প্রজনেনর জন্য খাঁচার ভিতর বিশেষ ব্যবস্থা করা প্রয়োজন যেখানে মা কবুতর তা’ দিতে পারে। মা কবুতরটির জন্য অবশ্যই খনিজ সমৃদ্ধ খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে আর পর্যাপ্ত পানি তো থাকতেই হবে। যখন থেকেই বাচ্চাগুলো ঐ বাসা থেকে উঁকি দেয়া শুরু করবে তখন থেকেই আস্তে আস্তে তাদেরকে ওড়ানো শেখার দিকে খেয়াল করতে হবে। মজার ব্যপার হলো পুরুষ কবুতর এবং মা কবুতর উভয়েই বাচ্চাকে লালন পালন করে, বলা চলে ভীষণ ভালোবাসে। এরা উভয়েই বাচ্চাকে ওড়া শেখাতে চায়। তবে পুরুষ এবং স্ত্রী কবুতর- উভয়েই সমান জোরে উড়তে পারে যদিও অনেকে বলে থাকেন পুরুষ কবুতর বেশি দ্রুত উড়তে পারে।
বাংলাদেশে অনেকেই নানান শখ পালন করে থাকেন। কিন্তু কবুতর পালন এবং এর ওড়ানোর প্রতিযোগিতার যে নির্মল আনন্দ তা অনেকেই জানেন না। তরুণরা শখের এই বিষয়টি নিয়ে খোঁজ খবর নিতে পারেন। সামান্য ব্যবস্থাপনায় নিতে পারেন বাড়তি আনন্দ। যারা দীর্ঘ দিন এটার সাথে আছেন, তাদের সাথেও কথা বলে দেখতে পারেন। তাদের থেকে পেতে পারেন আরো সুন্দর পরামর্শ। ভালো কাটুক সবার সময়, নির্মল আনন্দে।