মৌসুমি ফলের যত স্বাস্থ্যগুণ
চলছে বর্ষাকাল। হালকা টুপটাপ বৃষ্টি তো লেগেই আছে। তবে সেই তুলনায় কমেনি গরম। আবহাওয়া এবং করোনাকালীন বর্তমান পরিস্থিতি উভয়ই খুব বেশি অনুকূলে নয়। তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আমাদের শরীরকে যতটা সম্ভব সুস্থ রাখার চেষ্টা করতে হবে এবং বাড়াতে হবে রোধ প্রতিরোধ ক্ষমতা। আর শরীরের সুস্থতার জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের ভূমিকা নতুন করে বলার কিছু নেই। পুষ্টিমান বিবেচনায় আমাদের দেশের মৌসুমি ফলগুলো অতুলনীয়।
নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার সুবাদে এদেশে বিভিন্ন মৌসুমে যেমন হরেক স্বাদের ও বর্ণের ফলের দেখা মেলে, তেমনি একেক ফলের থাকে একেক পুষ্টিগুণ। গ্রীষ্ম চলে গেলেও এখনো বাজারে পাওয়া যাচ্ছে গ্রীষ্মকালীন অনেক ফল। এছাড়া তাজা-টাটকা মৌসুমি ফলের স্বাদই আলাদা, যা কোনোভাবেই বছরের অন্যান্য সময়ে পাওয়া যায় না। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, তালের শাঁস, ইত্যাদি ফল এখন প্রচুর পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। এসব ফল হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন এবং খনিজের সহজ উৎস। পাশাপাশি এ ফলগুলো অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যেমন- শর্করা, আমিষ, পানি এসব কার্যকরী উপাদানও দেহে সরবরাহ করে দেহকে সুস্থ রাখে। তাই আজ আমরা বিভিন্ন মৌসুমী ফলের পুষ্টিগুণ, স্বাস্থ্যগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে জানবো।
আম
ফলের রাজা আম কিন্তু এমনি এমনি নয়, স্বাদে ও গুণেও ফল হিসেবে আম অনন্য। আম পছন্দ করেন না এমন খুব কম মানুষই আছেন। আমাদের দেশে আমের বিভিন্ন জাতের মধ্যে ল্যাঙরা, ফজলি, হিমসাগর, আম্রপালি, গোপালভোগ, হাড়িভাঙ্গা ইত্যাদি অধিক জনপ্রিয়। আমের টসটসে পাকা আম তো বটেই, নানান মুখরোচক দেশী-বিদেশী পদও তৈরি হয় এই আম দিয়ে। আমে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ যা অন্য যেকোনো ফলের তুলনায় অনেক বেশি। এ ছাড়া আমে থাকে ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, খনিজ লবণ, ক্যালসিয়াম ও ক্যারোটিন। আম চুলপড়া, চামড়ার খসখসে ভাব, হজমের সমস্যা, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা ইত্যাদি দূর করে থাকে।
জাম
“পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ” – কী, পল্লীকবির লেখা এই পংক্তিতে ছোটবেলার কথা নিশ্চয়ই মনে পড়ে গেলো? টকমিষ্টি জাম লবণ মরিচ দিয়ে খাবার কথা শুনলেই জিভে জল চলে আসে আমাদের প্রায় সবারই। পাতলা কালো চামড়ার আবরণে ঢাকা এই ফলের ভেতরটা হালকা গোলাপি থাকে, পাকলে যা গাঢ় বেগুনি বর্ণ ধারণ করে। আয়ুর্বেদ এবং ভেষজ গুণাবলী সমৃদ্ধ এই ফলে রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। জামে প্রচুর প্রিমানের ভিটামিন সি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, জিংক, কপার, ফসফরাস, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি উপাদান থাকে যা উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ওজন নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস, ঘাতক ক্যান্সার প্রতিরোধেও সক্ষম।
কাঁঠাল
কাঁঠালকে জাতীয় ফল কেন ঘোষণা করা হয়েছে জানেন তো? শুধু ফলই নয়, কাঁঠালের প্রতিটি অংশই ফেলে দেওয়ার মতো নয়। গ্রামবাংলায় প্রচলিত আছে যে একটি কাঁঠাল গোটা একটি পরিবারের পেট ভরাতে পারে। ছোট শিশু, গর্ভবতী নারী এবং বয়স্ক ব্যক্তি – সকলেই খেতে পারে, এতটাই কার্যকরী এই ফল। ছোট কাঁঠালের মুচি ভর্তার মতো বানিয়ে খাওয়া হয়। কাঁচা অবস্থায় কাঁঠাল সবজি হিসেবে রান্না করে খাওয়া যায়। রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে কাঁচা কাঁঠাল। আর কাঁঠালের বিচি তো আলুর মতোই বিভিন্ন শাকসবজির সাথে রান্না করা যায়। আর পাকা কাঁঠাল শক্তিবর্ধক হিসেবে কাজ করে, কেননা এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে শর্করা, ফ্রুক্টোজ ও সুক্রোজ।
লিচু
রসালো মিষ্টি এই ফলটি খুব কম সময়ের জন্য পাওয়া যায়। মৌসুমি এই ফলটি ভিটামিন ও খাদ্যশক্তির অন্যতম প্রধান উৎস। লিচুতে প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান ভরপুর রয়েছে। ভিটামিন সি এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্টে পূর্ণ এই ফল মরণব্যাধী ক্যান্সার বিশেষত স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সক্ষম। এছাড়াও এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বেশ কার্যকর। দাঁত, হাড়ের মজবুত ভাব এবং ত্বকের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য বজায় রাখতেও এই ফল ভূমিকা রাখে।
আনারস
বাইরে খাঁজকাটা আর ভেতরে সুমিষ্ট রসে টইটুম্বুর আনারস শরীরে পানির চাহিদা মেটায়। পুষ্টিগুণে অতুলনীয় এই ফল। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলটিতে ভিটামিন এ এবং ভিটামিন বি ও যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। ঠান্ডা-কাশি-জ্বর এমনকি জন্ডিসের ক্ষেত্রে ভেষজ হিসেবে কাজ করে। ক্ষত সারাতেও এই ফলটি দারুণ উপকারী। আনারস রক্ত পরিষ্কার রাখে ফলে এটি রক্তনালী, শিরা বা ধমনীতে চর্বি জমা রোধ করে। কিডনি এবং পেটের বিভিন্ন সমস্যায় যুগ যুগ ধরে গ্রামবাংলায় সমাধান হিসেবে এই আনারস ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হাঁপানি ও গেঁটে বাতের সমস্যায়ও আনারস প্রাকৃতিক ঔষধ হিসেবে খাওয়া হয়। শুধু ফলই নয়, এর পাতার রসেও আছে ঔষধি গুণাগুণ।
তালের শাঁস
ভাদ্র মাসে তাল পাকার আগে এই তালের শাঁসই আমাদের গরমের প্রখর দাবদাহে তৃষ্ণা মেটাতে সাহায্য করে। অসম্ভব জনপ্রিয় কচি তালের শাঁসের স্বাদ অনেকটা নারিকেলের মতোই। হালকা মিষ্টি স্বাদের পানিতে ভরপুর এই শাঁসে আছে শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, খাদ্যআঁশ, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ, থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন ইত্যাদি উপাদান যা হাঁড় ও দাঁতকে মজবুত করে, দৃষ্টিশক্তি বর্ধন করে, এছাড়াও পানিশূন্যতা ও রক্তশুন্যতা দূর করতেও এটি দারুণ সহায়ক। এই ফলে বিদ্যমান এন্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। খাবারের রুচি বাড়িয়ে দিতেও জুড়ি নেই এই ফলটির।
ডেউয়া বা ঢেউফল
গ্রামবাংলার পরিচিত এবং জনপ্রিয় একটি ফল ডেউয়া বা ঢেউফল। শহরাঞ্চলে পাওয়া গেলেও ততটা জনপ্রিয় নয় ফলটি। গুচ্ছজাতীয় এই ফলটি কাঁঠালের গোত্রভুক্ত। টকমিষ্টি এই ফলটি অসাধারণ ভেষজ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থায়ই খাওয়া যায় এই ফল। ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম এবং ভিটামিন সি এর খুব ভালো উৎস ডেউয়া ফল। এই ফলটি রুচি বাড়াতে, ওজন নিয়ন্ত্রণে, এবং পেটের সমস্যা সাড়াতে অসম্ভব কার্যকরী। ডেউয়া ত্বক ও দাঁতের বিভিন্ন সমস্যা দূর করে এবং যকৃতের অসুখ, কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময় এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে বিস্ময়ের মতো কাজ করে ফলটি। এই গাছের ছালও কিন্তু সমান উপকারী। তাই আমাদের উচিত প্রায় হারিয়ে যাওয়া এই ফলটি সংরক্ষণে এগিয়ে আসা।
লটকন
গুচ্ছজাতীয় আর একটি দেশীয় ফল হচ্ছে লটকন। গ্রামে বনে-বাদাড়ে অযত্নে জন্ম নিলেও শহরে রাস্তার ধারেই ফলের ঝুরিতেদেখা মেলে এই ফলের। এর ভেতরের শাঁস সাদা হয় এবং মুখে দেওয়ার পর হালকা বেগুনি বর্ণ ধারণ করে। টকমিষ্টি এই ফলটি হচ্ছে ভিটামিন সি এর আধার। চর্মরোগ, মুখের স্বাদবদল, তৃষ্ণা নিবারণ এবং পেটের সমস্যা সাড়াতেও ব্যবহৃত হয় এই ফল। শুধু ফল নয়, এর বীজ, শিকড়, ছাল-বাকল এবং পাতায়ও রয়েছে ঔষধি গুণাগুণ। তবে একই সাথে অধিক ফল গ্রহণে ক্ষুধামন্দার উদ্রেক হতে পারে বলে জানান অনেক স্বাস্থ্য বিশারদগণ।
উপসংহার
আশা করছি মৌসুমি বিভিন্ন ফলের বিভিন্ন গুণাগুণ আজকের লিখাটিতে কিছুটা হলেও আমরা তুলে ধরতে পেরেছি। এর মধ্যে কিছু ফল পরিচিত হলেও কিছু কিছু ফল হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মধ্য থেকে। একেক ফলে থাকে একেক ভেষজ ও খাদ্যগুণ। সুতরাং পরবর্তী প্রজন্মকে এইসব ফল চেনাতে বিদেশী ফলের পাশাপাশি দেশী ফল খাবারও অভ্যাস করতে হবে। টাটকা এবং বিশ্বস্ত বিক্রেতার কাছ থেকে ফল কিনতে আজই আমাদের সাইটে ভিজিট করুন।