মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস ২০১৬
এই বছর মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস ছিল স্মার্টফোনের জন্য সবচেয়ে বড় ঘটনা। বিশ্বের সব নামিদামি কোম্পানিগুলো তাদের সেরা পণ্যের প্রদর্শন করেছে এই কংগ্রেসে। তাই অপেক্ষাকৃত গতানুগতিক কনজ্যুমার ইলেক্ট্রনিক্স সো (সিইএস) এর পর এবার সবার চোখ ছিল মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস ২০১৬ এর দিকেই। এই কংগ্রেসে অংশগ্রহণকারী কোম্পানিগুলোর প্রদর্শিত পণ্য গ্রাহকদের হতাশ করেনি। স্পেনের বার্সেলোনাতে অনুষ্ঠিত মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে প্রদর্শিত সেরাদের সেরা পণ্যগুলোর তালিকা তুলে ধরা হলো।
স্যামসাংয়ের সেরা গ্যালাক্সি এস৭ (সেভেন) /এস৭ এজ:
স্যামসাংয়ের সর্বশেষ ফ্ল্যাগশিপের উপর আমরা সর্ম্পূণ আলাদা একটি পোস্ট দিয়েছি। কিন্তু এটি স্যামসাংয়ের এই পণ্যের বিষয়ে সামান্য (সংক্ষিপ্ত) বর্ণনামাত্র। স্যামসাং বিগত দিনের পণ্যের উপর তাদের ক্রেতাদের প্রতিক্রিয়া এবং অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে শোনার পরই মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে এসেছিল। স্যামসাংয়ের এস৬ (সিক্স) সম্পর্কে ক্রেতা সাধারণের বেশকিছু অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে রয়েছে এস৬ এর ব্যাটারির কার্যক্ষমতা, স্টোরেজ (মেমরি) বর্ধিত বা বিস্তার করা এবং পানি প্রতিরোধ ক্ষমতা। স্যামসাংয়ের গ্রাহকরা (ক্রেতা সাধারণ) তাদের কাছে যেমনটি প্রত্যাশা করেন বা চান ঠিক সেরকমই কিছু অফার (পণ্য নিয়ে এসেছে) দিয়েছে। কোম্পানিটি তাদের এস৬ কে পরিমার্জন করে একেবারে নতুন ডিজাইনে বাজারে এনেছে। অনেক সমালোচক রহস্যেরচ্ছলে এটাকে গ্যালাক্সি এস৬ এস বলছেন। তা সত্ত্বেও স্যামসাং তাদের যে নতুন পণ্য নিয়ে এসেছে তা ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে এবং চলতি বছর স্মার্টফোনের বাজারে এটি ব্যাপক প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এলজি’র যুগান্তকারী মড্যুলার জি৫ (ফাইভ):
এলজি ইলেক্ট্রনিক্স তাদের দক্ষিণ কোরিয় প্রতিবেশি এবং প্রধান প্রতিযোগী কোম্পানি স্যামসাং সম্পর্কে অনেক ভালোই জানে। স্যামসাং এস৬ এর বাস্তবিক (ফিজিক্যাল) বড় ধরনের কোন পরিবর্তন না করেই বরাবরই মতোই খুব ভালো ডিজাইন করা হয়েছে। ফ্ল্যাগশিপ লাইনের পদ্ধতি ও আকৃতিগত মিল রেখেই এলজি তাদের জি৫ কে দেখিয়েছে। জি৫ খুব সন্দর মেটাল এবং ইউনিবডি ডিজাইনের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। এতে রয়েছে স্যামসাং এস৭ এর মতো একইরকম বৈশিষ্ট্য। তবে এটির প্রধান আকর্ষণ বা বৈশিষ্ট্য হলো ম্যাজিক স্লট। এটি মূলত একটি মড্যুলার যার মাধ্যমে এর ব্যবহারকারী ডিভাইসের ব্যাটারি খুলে এবং এটিতে নতুন মড্যুল সংযোজন করে ফাংশন বাড়াতে পারবেন। এলজি তাদের সংবাদ সম্মেলনে ব্যাটারি কার্যকারিতা বাড়াতে পারে এমন ক্যামেরা গ্রিপ এবং হাই-ফাই অডিও সংযুক্তিকরণ প্রদর্শন করেছে। জি৫ এর প্রথম প্রধান ফ্ল্যাগশিপ সংযুক্তি হচ্ছে মড্যুলারের অগ্রগতির ক্ষেত্রে এবং এটি আগামী দিনের স্মার্টফোন প্রযুক্তির জন্য একটি দারুন বিষয় হবে।
শিয়াওমি’র এমআই৫ প্রো ফ্ল্যাগশিপ কিলার:
এস৭ এবং জি৫ উত্তরের যে কোন জায়গায় (রাষ্ট্রে) খুচরা বিক্রির জন্য ৬৫০ ডলার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিভাইসটির যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে এটিকে আপনি নায্যমূল্য মনে করতে পারেন। এবার এখানে শিয়াওমি’র এমআই৫ প্রো এক ঝলকে দেখে নিন। ডিভাইসটিতে রয়েছে স্ন্যাপড্রাগন ৮২০ প্রসেসর, ৪জিবি এলপিডিডিআর ৪ র্যাম, একটি সনি ১৬ মেগাপিক্সেল আইএমএক্স সেন্সর, ১২৮ জিবি স্টোরেজ, ১০৮০ পি (ফুল হাই ডেফিনিশন -এফএইচডি মুড) ডিসপ্লে, একটি ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার এবং শিয়াওমি’র এমআইইউআই ৭ (মি ইউজার ইন্টারফেস) এর সাথে অ্যান্ড্রয়েড ৬.০ মার্শম্যালো।
ডিভাইসটির যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এসব বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে কি আপনারা পরিচিত না? কারণ ডিসপ্লে বাদে এস৭ এবং জি৫ এর অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলোও এতে অভিন্ন। সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং দারুন তথ্য হচ্ছে যে, এই ডিভাইসটির দাম মাত্র ২৮ হাজার ৬০০ টাকা (ভ্যাট ছাড়া)। এমআই৫ প্রো শুধু বৈশিষ্ট্যগুলোই কপি করেনি একইসাথে দামের ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতা করছে। ডিভাইসটি’র বৈশিষ্ট্য হলো এটির থ্রিডি মড্যুলড সিরামিক ব্যাক এবং ফুল মেটাল চেসিস। এমআই৫ প্রো ডিভাইসটিও সারাবিশ্বের বাজারে অবমুক্ত হতে দেখা যাবে। যদিও শিয়াওমি এর পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট করে কোন মার্কেটের কথা উল্লেখ করা হয়নি, যেখানে এটি রিলিজ হবে।
৩৬০ ডিগ্রি ভিডিও’র সাথে স্যামসাং মেইনস্ট্রিমে (মূল ধারায়) যাচ্ছে:
৩৬০ ডিগ্রি ভিডিও এবং ভার্চুয়াল রিয়ালিটি এক সঙ্গে বেশ ভালোই যাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে ৩৬০ ডিগ্রি ভিডিও এবং ভার্চুয়াল রিয়ালিটির জনপ্রিয়তা অভূতপূর্বভাবে বাড়তে দেখা যাচ্ছে এবং এ কারণে স্যামসাং গিয়ার ৩৬০ ভিডিও ক্যামেরার সাথে পুরোপুরিভাবে স্যামসাংকেও দেখা যাবে। ছোট গোলাকৃতির এই ডিভাইসটির একটি ক্ষুদ্র ট্রাইপড (তেপায়া বস্তু) এবং নিচের দিকের অংশটা সমতল রয়েছে। এর ফলে ওই ডিভাইসটি যে কোন সমতল পৃষ্ঠের উপর খুব সহজেই রাখা যায়। ৩০ মেগাপিক্সেলের ছবি তুলতে এর দুটি ক্যামেরাই একত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে। যদিও এর ছবির মান খুব অসাধারণ কিছু না। স্যামসাং তাদের ক্রেতাদের হাতে জনপ্রিয় এই ৩৬০ ভিডিও মুভমেন্ট প্রযুক্তি পৌছে দিতেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেছে। ডিভাইসটি ফ্লাই (শূণ্যেও) অবস্থায় স্যামসাংয়ের নতুন ফ্ল্যাগশিপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং এর ফিচারগুলো একটি মাইক্রোএসডি কার্ড স্লটে স্টোরেজ থাকবে। এই স্টোরেজ ১২৮ জিবি পর্যন্ত বর্ধিত করা যাবে। স্যামসাংয়ের স্পন্সর করা ৮৮তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে বিখ্যাত ইউটিউবার কেজি নাইসটেটের হাতেও গিয়ার ৩৬০ দেখা যাবে। তাই আপনার চোখ খোলা রাখুন। এলজিও তাদের ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরা অবমুক্তি করেছে। তবে স্যামসাং ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরায় যতটা গ্রাহকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এলজি’র ক্যামেরা ততটা করতে পারেনি।
অপ্পো’র রেভ্যুলশনারি সুপার ভুক (ভিওওসি) মোবাইল চার্জিং:
বেশ কিছুদিন ধরেই স্মার্টফোন চার্জিং শিল্পকে নেতৃত্ব দিচ্ছে অপ্পো। স্মার্টফোনের বিশ্বে চার্জিং সমস্যা সমাধানের জন্য অপ্পোর ভুক চার্জিং সলিউশনকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে এবং প্রতিবছরই অপ্পো তাদের এই পণ্যটি’র প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন এবং উন্নতি করছে। এবার তো অপ্পো সাফল্যের দিক দিয়ে তাদের নিজেদেরকেই ছাড়িয়ে গেছে। এবছরের মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে অপ্পো তাদের কোন নতুন স্মার্টফোন প্রদর্শন করেনি। কিন্তু তাদের সুপার ভুক মোবাইল চার্জিংয়ের কারণে তারা দর্শকদের করতালি পেয়েছে এবং প্রশংসা কুড়িয়েছে। অপ্পোর সুপার ভুক চার্জিং দিয়ে আপনি আপনার ফোনের ২৫০০ মিলি অ্যাম্পিয়ার আওয়ার (এমএএইচ) ব্যাটারির ৪৫ শতাংশ চার্জ দিতে পারবেন মাত্র ৫ মিনিটে এবং ১০০ ভাগ চার্জ হবে মাত্র ১৫ মিনিটেই! অপ্পো তাদের নতুন যে ডিভাইসটি নিয়ে এসেছে এটি যদি মোবাইল ফোনের ব্যাটারির জীবনকাল (লাইফস্পেন) বা কার্যকারিতার কোন ক্ষতি না করে সফলভাবে নতুন স্মার্টফোনের সাথে কাজ করাতে পারে, তাহলে বিশ্বব্যাপী ব্যাটারি নিয়ে যে সমস্যা বা দুশ্চিন্ত রয়েছে তারা এর একটি সাফল্যজনক সমাধান করতে পারবে।
প্রযুক্তির বিশ্বে আগামী দিনে কি হতে যাচ্ছে বা কি হবে এর একটি প্রবেশপথ হচ্ছে মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসের মতো আয়োজনগুলো। যেখানে প্রযুক্তিতে নেতৃত্বদানকারী কোম্পানিগুলো তাদের নতুন নতুন পণ্যগুলোর প্রদর্শন করে এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা উপস্থাপন করে। এটা দেখতে ভালোই লাগে যে, নতুন নতুন পণ্য এবং মানের উৎকর্ষতার দিক দিয়ে এসব ইভেন্টে এক কোম্পানি অন্য কোম্পানিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আর দিন শেষে এসব বিস্ময়কর উদ্ভাবন এবং উদ্ভাবনী অভিনবত্বের কারণে ক্রেতারাই সবচেয়ে লাভবান হয়। কারণ এসব পণ্য উদ্ভাবন করা হয় ক্রেতাদের জন্যই। এবছর আমরা পর্যবেক্ষণ করলাম স্মার্টফোনের অত্যধিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কোম্পানিগুলো একজন অন্যজনের চেয়ে এগিয়ে যেতে, এক কোম্পানি অন্য কোম্পানির উপর জয়লাভ করতে চেষ্টা করছে। তবে এই প্রতিযোগিতার যুদ্ধ (পণ্যের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে) এখনো অনেক বাকি রয়েছে। আমরা আরও দেখলাম নতুন প্রযুক্তিকে গ্রহণ করে তা ক্রেতাদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ২০১৬ সালটি অনেক বেশি ঘটনাবহুল হতে যাচ্ছে এবং এখন এটা দেখার অপেক্ষা যে কোন কোম্পানি শীর্ষে আরোহন করে এবং তাদের পণ্যের মাধ্যমে সারাবিশ্বে আলো ছড়ায়।