পোষা প্রাণী নিয়ে ভ্রমণ: নিরাপদ ভ্রমণের পরামর্শ
আমাদের ঘরের ছোট্ট পোষা প্রাণীটি আমাদের কাছে পরিবারের যেকোনো সদস্যের মতোই প্রিয়। তাই আমরা যখন কোথাও বেড়াতে যাই, বিশেষ করে ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গেলে আমাদের অনেকেরই একটা চিন্তা থাকে পোষা প্রাণীটিকে নিয়ে কীভাবে নির্বিঘ্নে ভ্রমণ করা যায়। এছাড়াও অনেকে দেশের বাইরে গেলে তাদের পোষা প্রাণীকে সাথে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন।
কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করতে গেলে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। এই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে ভ্রমণের আগে, ভ্রমণকালীন ও ভ্রমণের পরে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাপার নিয়ে প্রস্তুতি রাখলে ও সেগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করলে খুব সহজেই আপনার পোষা প্রাণীটি আপনার সাথে ভ্রমণ করতে পারবে।
আর তাই এ ব্যাপারে আপনাকে পর্যাপ্ত তথ্য ও ধারণা দিতে আজকে আমরা এই আর্টিকেলে পোষা প্রাণী নিয়ে ভ্রমণ সম্পর্কিত সকল বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ভ্রমণের আগে প্রস্তুতি
ভ্রমণের আগে প্রস্তুতি হিসেবে পোষা প্রাণীর ভ্রমণ আরামদায়ক করতে প্রয়োজন এমন সকল জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে হবে। এর সাথে মেডিকেল নথিপত্র এবং টিকার কার্ড ও বিমানে ভ্রমণের ক্ষেত্রে পেট পাসপোর্ট, মাইক্রোচিপ, স্বাস্থ্য সনদ প্রভৃতির ব্যবস্থা করতে হবে।
যেসব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে হবে:
১) খাবার ও পানি: পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার ও পানি বায়ুরোধী বা এয়ারপ্রুফ বক্সে ও বোতলে ভরে রাখুন। আপনার পোষা প্রাণী যেই পাত্রগুলোতে খাবার ও পানি খায় সেগুলোও গুছিয়ে রাখুন। সাথে অতিরিক্ত খাবার ও পানিও রাখতে পারেন। তাহলে ভ্রমণে কোনো কারণে সময় বেশি লাগলেও আপনার পোষা প্রাণীকে খিদে বা পিপাসায় ভুগতে হবে না।
২) ওষুধ: ভেটেরিনারিয়ান বা ভেট কর্তৃক নির্ধারিত কোনো ওষুধ যদি থাকে যা ভ্রমণকালীন বা ভ্রমণের পরে খাওয়াতে হবে তা সংগ্রহ করুন। ওষুধ খাওয়ানোর জন্য সিরিঞ্জ বা অন্য সরঞ্জাম লাগলে তাও গুছিয়ে রাখুন।
৩) বিছানা ও খেলনা: পোষা প্রাণীর নিজস্ব বিছানা ও খেলনা থাকলে সেগুলোও নিয়ে নিন। পরিচিত ও পছন্দের সামগ্রী থাকলে তারা সেগুলো নিয়ে সময় কাটাবে, যা তাদের শান্ত রাখতে সাহায্য করবে।
৪) কলার, লিশ ও সনাক্তকরণ ট্যাগ: কলার ও লিশ পরানো থাকলে আপনি পোষা প্রাণীকে আপনার সাথে নিয়ে চলাচল করতে পারবেন। সে হঠাৎ করে দৌড় দিয়ে হারিয়ে যাবে এই আশঙ্কা থাকবে না। কোনোভাবে হারিয়ে গেলেও সনাক্তকরণ ট্যাগ তাকে দ্রুত খুঁজে পেতে সহায়ক হবে।
৫) লিটার ব্যাগ ও পি প্যাডস: পোষা প্রাণীর মল-মূত্র ত্যাগের জন্য লিটার ব্যাগ ও পি প্যাডস কিনে রাখুন। বিশেষ করে বিমান ভ্রমণের সময় লিটার ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পি প্যাডস খুব কাজে দিবে।
৬) প্রাথমিক চিকিৎসা কিট: এই কিটে টুইজার, ব্যান্ডেজ, নেবানল পাউডার, ভায়োডিন, ব্রাশ, নেইল ক্লিপার প্রভৃতি রাখতে পারেন। ভ্রমণকালীন প্রাণীটি কোনো আঘাত পেলে এগুলো দিয়ে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা করতে পারবেন।
যেসব প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ব্যবস্থা করতে হবে:
১) পেট পাসপোর্ট: পোষা প্রাণীর টিকার তথ্য, সনাক্তকরণের বিশদ বিবরণ ও অন্যান্য স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত তথ্য সম্বলিত পেট পাসপোর্ট আপনার ভেটের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন।
২) স্বাস্থ্য সনদ: আপনার পোষা প্রাণীর শরীরে কোনো সংক্রামক রোগের জীবাণু নেই তা নিশ্চিত করে এই স্বাস্থ্য সনদটি প্রস্তুত করে তাতে স্বাক্ষর দিবেন আপনার ভেট।
৩) মাইক্রোচিপ সনদ: অনেক দেশের শর্ত থাকে পোষা প্রাণী নিতে হলে তার সনাক্তকরণের জন্য তার মধ্যে একটি মাইক্রোচিপ ঢুকাতে হবে। এর অস্তিত্ব ও সঠিক কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করতে মাইক্রোচিপ সনদ সংগ্রহ করা আবশ্যক। এই সনদে মাইক্রোচিপের নম্বর রয়েছে, যা পোষা প্রাণী সনাক্তকরণে সাহায্য করে।
৪) অন্যান্য: দেশের বাইরে ভ্রমণের সময় ক্ষেত্রবিশেষে আমদানি/রপ্তানি পারমিট, কুকুরের জলাতঙ্ক টিকার সনদ প্রভৃতি কাগজপত্র প্রস্তুত রাখতে হয়।
ভ্রমণের জন্য সঠিক ক্যারিয়ার বা ক্রেট ব্যবহার করা
পোষা প্রাণীর ভ্রমণ আরামদায়ক করার জন্য সঠিক ক্যারিয়ার বা ক্রেট ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্যারিয়ার নির্বাচনে প্রথমে খেয়াল রাখতে হবে এটি যেনো যথেষ্ট বড় ও প্রশস্ত হয় এবং পোষা প্রাণী যেনো আরামে এর ভেতর দাঁড়াতে, বসতে ও ঘুমাতে পারে। নির্বিঘ্নে নড়াচড়া করতে পারার মতো জায়গা থাকলে ভ্রমণের সময় প্রাণীটি শান্ত থাকবে ও কোনো স্ট্রেসে ভুগবে না।
অনেক কুকুর ভ্রমণের সময় মোশন সিকনেসে অসুস্থ বোধ করে। সেজন্য তাদেরকে নির্দিষ্ট ওষুধ খাওয়ালে তা চাপ কমাতে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে অবশ্যই আগে ভেটের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে।
এরপরে যেটা খেয়াল রাখতে হবে তা হলো ক্রেটে যেনো পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো-বাতাস ঢুকে। পোষা প্রাণী, বিশেষ করে পোষা বিড়াল সাধারণত অতিরিক্ত গরম ও অতিরিক্ত ঠাণ্ডার প্রতি সংবেদনশীল হয়ে থাকে। তাই ভ্রমণকালীন যেহেতু লম্বা একটি সময় তাকে ক্রেটের মধ্যে কাটাতে হবে, এর অভ্যন্তরীণ পরিবেশ যেনো তার জন্য আরামদায়ক হয় তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো ক্রেট বা ক্যারিয়ারের ভেতর পোষা প্রাণীর পরিচিত জিনিসপত্র, যেমনঃ খেলনা, কম্বল ইত্যাদি রাখা। এগুলো তাকে মানসিকভাবে আরাম দিবে ও তার স্ট্রেস কমাতে সহায়ক হবে।
যানবাহনে ভ্রমণের সময় করণীয়
পোষা প্রাণী যেহেতু বাসায় থাকতে অভ্যস্ত, তাই তাকে নিয়ে বিভিন্ন যানবাহনে ভ্রমণ করা একটু জটিল হতে পারে। এজন্য যানবাহন ভেদে একেক ক্ষেত্রে একেক রকম প্রস্তুতি রাখলে তা আপনার ও তার জন্য সুবিধাজনক হবে। যেমন:
ব্যক্তিগত পরিবহনে ভ্রমণ
পোষা প্রাণী নিয়ে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পরিবহন সবচেয়ে আরামদায়ক পরিবহন মাধ্যম। তার আরামদায়ক যাত্রা নিশ্চিত করতে গাড়িতে তাকে পর্যাপ্ত জায়গা দিন ও তাকে ব্যস্ত রাখতে বিভিন্ন খেলনা রাখুন। ব্যক্তিগত পরিবহনে ক্রেট বা ক্যারিয়ার ব্যবহার না করে গাড়ির ভেতরে আপনার সাথেই তাকে রাখতে পারবেন।
ট্রেনে ভ্রমণ
যেহেতু ট্রেনে টিকেট পেতে প্রায়শই বেগ পেতে হয়, তাই পোষা প্রাণীকে নিয়ে ভ্রমণ করতে হলে আগেই টিকিট কেটে আসন নিশ্চিত করুন। ক্ষেত্রবিশেষে যদি পোষা প্রাণীকে আপনার কোলে ক্যারিয়ারে নিয়ে রাখা সম্ভব না হয়, তখন তার জন্য আলাদা টিকিট কিনতে হতে পারে।
অর্থাৎ তার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে জায়গার ব্যবস্থা করা বাঞ্ছনীয়। তাহলে ভ্রমণকালীন কোনো সমস্যা হবে না। তবে এক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে যে ট্রেনের টিকেট কাটছেন তাতে পোষা প্রাণী নিয়ে ভ্রমণ করার অনুমতি আছে।
বাসে ভ্রমণ
এখানেও ট্রেনে ভ্রমণের মতো একই পন্থা অবলম্বন করতে হবে। তবে অধিকাংশ বাসে পোষা প্রাণী নেওয়ার অনুমতি নেই। তবে কিছু বাস অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে অনুমতি দিয়ে থাকে। এ ব্যাপারে আগে জেনে এরপর টিকিট কাটবেন।
নৌকায় ভ্রমণ
নৌকায় ভ্রমণের সময় পোষা প্রাণীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাশাপাশি একটি লাইফ জ্যাকেট সাথে রাখতে পারেন। ভ্রমণের আগে এটা পরিয়ে দিবেন ও ভ্রমণের পর খুলে ফেলবেন।
বিমানে ভ্রমণ
বিমানে পোষা প্রাণী নিয়ে ভ্রমণ করার বিষয়টি দেশ ও বিমানসংস্থার ওপর নির্ভর করে। যেমন:
- কিছু বিমানসংস্থা বিমানের নিচের লাগেজ কম্পার্টমেন্টে পোষা প্রাণী বহন করার অনুমতি দেয়। কিছু ক্ষেত্রে পোষা প্রাণীকে আপনার সাথে একই বিমানে রাখতে পারবেন ও সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত লাগেজ হিসেবে ফি দিতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে কার্গো সার্ভিসের মাধ্যমে পোষা প্রাণীকে পাঠানো হয়। পোষা পাখির ক্ষেত্রে কার্গো সুবিধাজনক ব্যবস্থা হতে পারে।
- কিছু ক্ষেত্রে আপনি আপনার সিটের নিচে আপনার বিড়াল বা কুকুরকে ক্যারিয়ারে করে রাখতে পারবেন। সেক্ষেত্রে বিড়াল বা কুকুর কোনোটারই আকার বেশি বড় হওয়া যাবে না এবং ভ্রমণের পুরো সময় তাকে ওখানে ক্যারিয়ারের মধ্যে রাখতে হবে।
- কিছু বিমানে পোষা প্রাণী নেওয়ার অনুমতি নেই। তাই টিকিট কাটার আগে বিমানসংস্থার পলিসি সম্পর্কে জেনে নিবেন।
ভ্রমণের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম ও পটি ব্রেকের ব্যবস্থা করা
বাসে, ট্রেনে, বিমানে ও ব্যক্তিগত পরিবহনে দীর্ঘ সময়ের ভ্রমণের ফাঁকে যখনই বিরতি পাবেন, পোষা প্রাণীটির বিশ্রাম ও পটি ব্রেকের ব্যবস্থা করবেন। এক্ষেত্রে যেহেতু তাকে ক্যারিয়ার থেকে বের করতে হবে, তাই পুরো সময় তাকে হারনেস ও লিশ পরিয়ে রাখবেন। এতে করে তার হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমবে।
পোষা প্রাণীসহ হোটেলে থাকার পরিকল্পনা
হোটেলের ক্ষেত্রেও যানবাহনের মতোই আগে থেকে খোঁজ নিতে হবে যে হোটেলে পোষা প্রাণী রাখার অনুমতি আছে কি না। এর পাশাপাশি খেয়াল রাখবেন যেই রুমে আপনি থাকছেন তার দরজা-জানালা ভালোভাবে লাগানো যাচ্ছে কি না, বারান্দার রেলিং-এর উচ্চতা পোষা প্রাণীর জন্য নিরাপদ কি না। সর্বোপরি, যতক্ষণ পোষা প্রাণীকে নিয়ে থাকছেন ততক্ষণ তার ওপর দৃষ্টি রাখবেন যাতে তার থাকা-খাওয়া, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি স্বাভাবিক থাকে।
ভ্রমণ শেষে করণীয়
ভ্রমণ শেষে বাসায় ফেরার পর পোষা প্রাণীকে তার আগের রুটিনে ফেরত আনুন। এ সময়ে তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা চোখে পড়লে দ্রুত আপনার ভেটের সাথে কথা বলুন।
উপসংহার
আদরের পোষা প্রাণীটিকে নিয়ে নিরাপদে ভ্রমণ করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি বিষয় হলো: পোষা প্রাণীর প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র সরবরাহ করা ও যাত্রার পরিবহন মাধ্যমের শর্ত অনুযায়ী সকল কাগজপত্র প্রস্তুত রাখা। এগুলো যথাযথভাবে মেনে চললে তাকে বাসায় রেখে যেতে হবে না আবার ভ্রমণের চ্যালেঞ্জগুলোও মোকাবেলা করতে হবে না। প্রিয় ছোট্ট বন্ধুর সাথে প্রতিটি ভ্রমণই হবে সুন্দর একেকটি অভিজ্ঞতা!
পোষা প্রাণী সম্পর্কে এমন আরো প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে চোখ রাখুন Bikroy- এ!