ডিজিটাল যুগে বাংলাদেশের প্রপার্টির বাজার
আজকের ঢাকা একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী। প্রায় ১ কোটি মানুষের বসবাসের এ শহরটি সারাবিশ্বের অন্যতম দ্রুততম ক্রমবর্ধমান নগরী।
১৯৪৭ এর দেশভাগের পর থেকে ঢাকা শহরটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ আসনে রুপ নেয়। এরপর থেকে এ নগরীর জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ১৯৭১ এ স্বাধীনতার পর থেকেই ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী ও প্রধান শহরে রুপ নেয়।
জনবহুল ও দ্রুত উন্নয়নশীল এ দেশের রাজধানী হওয়ায়, ঢাকা নগরী বাংলাদেশের প্রপার্টি বাজারের প্রধাণ চালিকাশক্তি।শহরটির ব্যাপ্তি বাড়ানোর জন্য যথেচ্ছ উদ্যোগ নিয়ে একে বিশ্বের অন্যতম বড় শহরগুলোর একটিতে পরিণত করার চেষ্টা চলছে, তবে উদ্যোগগুলো অধিকাংশেই অসফল।
অন্যান্য উন্নয়নশীল শহরের তুলনায় ঢাকা শহরের বসবাসকারীদের জীবন-মান বাড়েনি বৈকি আস্তে আস্তে কমেছে। জীবন-মান এর এই নিম্নগামীতার প্রভাবে শহরটির অবকাঠামো পরিবর্তিত হয়ে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক নাগরিকের আশেপাশে প্রায়শই এমন ঘটনা ঘটছে যা শহরটিকে পরিপূর্ণ উপায়ে বর্ধিত করার জরুরি প্রয়োজনের কথা প্রতিনিয়ত সবাইকে মনে করিয়ে দেয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনের একটি সরকারি সংস্থা ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ (রাজউক) যথাযথ উপায়ে ঢাকা শহরটির উন্নয়ন ও পরিবর্ধনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৮৭ এর আগ পর্যন্ত রাজউক এর নাম ছিল ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি)। এই সংস্থার প্রাথমিক লক্ষ্য হলো নগরের যথাযথ উন্নয়ন, পরিকল্পনা ও এর অধিবাসীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রদানের মাধ্যমে শহরটির বিকাশ, উন্নতি, প্রসারণ এবং এর পরিচালনা। একটি পরিকল্পিত নগরায়ণ এবং তার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজউক ঢাকা মহানগরীর উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে প্রধান ভূমিকা পালন করে।
‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ বাংলাদেশ সরকারের একটি সরকারী সংস্থা যেটি ঢাকা শহরের শহুরে বিকাশের একমাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত। সরকারি কর্মকর্তা, শহর পরিকল্পনাকারী, শহুরে প্রশাসক, প্রকৌশলী ও স্থপতির সমন্বয়ে এই সংস্থাটি গড়ে উঠেছে।
সরকারী অনুমোদিত বোর্ড হিসেবে এটির অনেক ক্ষমতা রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম বিল্ডিং, এস্টেট ও সম্পদ পরিকল্পনা, সরকারী ও বেসরকারি সংস্থাগুলির কাছ থেকে প্লট বরাদ্দ ও নির্মাণ অনুমোদন। রাজউক এর পূর্বসূরী হিসেবে ১৯৬৯ সালের ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাষ্ট (জমি বরাদ্দ) রুল ও ১৯৫৩ সালের টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাকট, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে উভয়ই অস্তিত্ব লাভ করেছিলো। তাই এই সংস্থাটির একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে তা বলাই যায়।
তবে অধিকাংশক্ষেত্রেই কর্মকান্ডের দিক দিয়ে সংস্থাটি নিশ্চল ছিলো। পরিপূর্ণভাবে উদ্ধোধনের ৪ বছর পর এটি তার কিছু কার্যক্রম অটোমেশনের মাধ্যমে ডিজিটালাইজেশনের পথে পা রাখছে। রাজউক বর্তমানে নিম্নলিখিত সেবাগুলো অনলাইনে দিচ্ছে, এগুলো হলোঃ
- বিল্ডিং গঠন অনুমোদন
- ভূমি ব্যবহারের ক্লিয়ারেন্স
- নির্মাণ অনুমতি
রাজউকের এই পদক্ষেপ কি জনগণের জন্য?
উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো থেকে জানা যায়, এই নগরীতে একটি বাড়ি বানানোর জন্য সরকারী এই সংস্থাটির অনুমোদন একটি আবশ্যক জিনিস। তবে বছরের পর বছর ধরে, রেকর্ড ও রেকর্ডের বাইরে এই সেক্টরে হয়রানি ও চাঁদাবাজির ঘটনা ও সংখ্যাগুলি আশংকাজনকভাবে অনেক বেশী।
ম্যানুয়াল কিংবা প্রথাগত উপায়ে আবেদন শুধু যে সময় ক্ষেপনকারী তা নয়, এই উপায় আবেদনকারীদের নিয়ে নানা সময়ে হয়রানির ঘটনা শোনা গিয়েছে। এসব নিরসনে রাজউক সরকারীভাবে ঘোষণা দিয়েছে আবেদনকারীরা তাদের আবেদন জমা দিতে পারবেন অনলাইনে শুধুমাত্র রাজউক এর cp.rajukdhaka.gov.bd এই অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে নিবন্ধনের মাধ্যমে।
আবেদনকারীদের তথ্যগত সাহায্য প্রদানের জন্য একটি হটলাইন নাম্বার ও চালু রাখা হয়েছে যা হলো ০১৯২২-০০০৬৬৬।
গ্রাহক সেবার লক্ষে বাংলাদেশ সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী অ্যাডভোকেট স ম রেজাউল করিমকে দিয়ে রাজউক এই অনলাইনভিত্তিক সেবার উদ্ধোধন করেছিলেন চার বছর আগে ২০১৫ এর ডিসেম্বর মাসে। তবে এই অটোমেশনের ফলে গ্রাহক কিংবা আবেদনকারীর পর্যায়ে ভোগান্তি ও অপেক্ষার পরিমান তেমনভাবে কমেনি।
বর্তমান ব্যবস্থাটি ধানমন্ডি, মোহাম্মাদপুর, লালবাগ, সূত্রাপুর ও কামরাঙ্গিরচর এলাকায় সীমাবদ্ধভাবে চালু করা হয়েছিলো। এরপর এখন পর্যন্ত ৭০০ এর মত আবেদনপত্র এর অনুমতি মিলেছে এসব এলাকা থেকে। তবে এই সেবা পুরো ঢাকা শহরজুড়ে বিস্তৃত করা এখন সময়ের দাবী।
সরকার ইতিমধ্যেই এই সেবা প্রদানের পরিসরকে বাড়ানোর তাগিদ অনুভব করেছে কিন্তু নানা প্রতিকূলতার জন্য এটি রাজউক এর পক্ষ থেকে এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এই সেবা প্রদান শুরু করার দীর্ঘসূত্রিতার অন্যতম কারন হলো সঠিক সরঞ্জাম ও পর্যাপ্ত জনবলের ট্রেনিং এর ঘাটতি।
ভবিষ্যতে অগ্রগতির জন্য রাজউক এর পরিকল্পনা
এটা বলতেই হয় রাজউক এর পক্ষে এই পথ পরিক্রমের ব্যাপারগুলো মোটেই সহজ ছিলোনা। এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে বছর খানেক আগে এবং ইতোমধ্যে কার্যপদ্ধতির ধাপগুলো সম্পর্কেও জানা ও বোঝা গিয়েছে। রাজউক এবারে বিল্ডিং কোড এ লঙ্ঘনকারীদের একটি তালিকা তৈরি করছে।
এই উপলক্ষে সমগ্র ঢাকা শহরে বিল্ডিং কোড লঙ্ঘনকারীদের খুঁজে বের করতে একটি ২ দিনের জরিপ চালানো হচ্ছে। ২৪ টি দল আলাদাভাবে সমগ্র রাজধানী জুড়ে ১০ তলা এর অধিক বিল্ডিংগুলো পরিদর্শন ও নিরীক্ষণ করবে।
রাজউক বিল্ডিংগুলোতে অনেকগুলো বিষয় নিরীক্ষণ ও পর্যালোচনা করবে যা হলোঃ
- অগ্নি নিরাপত্তা ও আগুনের জন্য ফায়ার এক্সিট
- জরুরী নিরাপত্তা ব্যবস্থা
- বিল্ডিং কোড, প্ল্যান ও রিপোর্ট
- অনথিভুক্ত নির্মাণ
- অনুমোদিত নকশা সম্মতি
ইতিমধ্যেই কিছু নিরীক্ষক দলের কাছ থেকে নানা ধরনের অসংগতির খবর জানা গেছে যেমন অনুমোদনহীনভাবে বাড়ির প্রবেশদ্বারে রেস্টুরেন্ট নির্মাণ, বিল্ডিং এর নির্মিত কাঠামোর সাথে অনুমোদনকৃত ডিজাইনের অমিল, জরুরী নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেমন ফায়ার এক্সিট এর অভাব ও অপ্রতুলতা ইত্যাদি।
নির্ধারিত আইনের ব্যতয়কারীর বিরুদ্ধে বিল্ডিং নির্মান নীতিমালার অধীনে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিল্ডিং নির্মাণ যথাযথভাবে না হওয়ায় গত কয়েক বছরের নানা দূর্ঘটনার ঘটনা এই প্রত্যেকটি বিল্ডিং কে খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তাকে জোড়ালো করছে।
এই পদক্ষেপই পারে ভবিষ্যতে এই প্রিয় নগর ও নগরবাসীকে অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনাগুলো থেকে রক্ষা করতে। এজন্য এগিয়ে আসতে হবে সরকার সংশ্লিষ্টদেরকেই।
বাংলাদেশের প্রপার্টি বাজার ও রাজউক
বহু বছর ধরেই অগনিত অপরিকল্পিত নির্মাণ ও নির্মাণবিধি লঙ্ঘনের ব্যাপারে রাজউক কে মৌন থাকতে দেখা গেছে। আশংকা এর বিষয় বিল্ডিং এর ডিজাইন অনুমোদন নিয়ে স্থপতিদের স্বাক্ষর জালিয়াতির ঘটনাও দেখা গেছে।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনষ্টিটিউট (আইএবি) এর প্রেসিডেন্ট একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন গবেষণায় তাঁরা ২০০০ এরও অধিক দূর্ঘটনার তথ্য পেয়েছেন। জাল স্বাক্ষর দ্বারা অনুমোদন দেখানো বিল্ডিংগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে তাঁরা রাজউক কে অনুরোধ করেছেন।
রাজউক এর পক্ষ থেকে অনুমোদিত বিল্ডিং এর গোপনীয় তথ্যাবলী যেমন ঠিকানা, মালিকের নাম, স্থপতির নাম সকলের জন্য উন্মুক্ত বিধায় এমন ঘটনা ঘটছে। অনেক স্থপতিই পরে জানতে পেরেছেন যে তাঁদের অগোচরে নাম ও স্বাক্ষর জালিয়াতি করে বিল্ডিং এর অনুমোদন নেয়া হয়েছে।
এর ফলশ্রুতিতে রাজউক এর পক্ষ থেকে এসব তথ্যাবলী জনসাধারনের সামনে প্রদর্শন বন্ধ করা হয়েছে। এবং এটি ঢাকা ও সারাদেশে অনুমোদন জালিয়াতির ঘটনাকে অনেকাংশে কমিয়েছে।
রাজধানীর বনানী এফআর টাওয়ারে আগুনের দূর্ঘটনায় ২৭ জনের প্রানহানির ঘটনার পর আইএবি আগুন নিরাপত্তা এবং জীবন রক্ষা সম্পর্কিত একটি সংবাদ সন্মেলনের আয়োজন করেছিলো। আগুন নিরাপত্তা ও অন্যান্য জরুরী নিরাপত্তা একটি নিয়মিত জিনিস হওয়া উচিত যেটি ইতোপূর্বে কতৃপক্ষের নজরদারিতে ছিলোনা। কিন্তু এ বিষয় নিয়ে ছেলেখেলা করার সময় আর হাতে নেই আমাদের।
অগ্নি নিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ, একটি বিল্ডিং এর সার্বজনীন অভিগমন, ফায়ার অ্যান্ড ইলেকট্রিসিটি ডিপার্টমেন্ট থেকে অনুমোদন ও ইত্যাদি নিরাপত্তা বিষয়ক বিভিন্ন আইন ইতিমধ্যেই করা হয়েছে।
কিন্তু আইন না মানা কিংবা আইনের ব্যতয় ঘটানোই সমস্যার মূল উৎস!
যদিও আইন ও প্রবিধানের সংখ্যা নিয়মিতই বাড়ছে, কেবলমাত্র তদারকি ও আইন জোরদারের অভাবে ঘটছে নানা অযাচিত ঘটনা, দূর্ঘটনা, প্রতিনিয়তই হারাচ্ছে অগনিত জীবন।
শেষ কথন
জাতীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ হিসেবে রাজউক এর উদ্যোগগুলো দুটি সেবায় বিভক্ত। একটি হলোঃ ভূমি ব্যবহারের ক্লিয়ারেন্স ও বিল্ডিং ডিজাইনের অনুমোদন। এই দুই কর্মকান্ডের অনলাইন সেবা নাগরিকদের জন্য ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে তা আর্টিকেলের শুরুতেই বলা হয়েছে।
তাই এই সেবাগুলোর ডিজিটাইজেশন ও অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে সেবা নেয়ার ব্যবস্থা গ্রাহকের দীর্ঘসূত্রিতা, হয়রানির হাত থেকে বাঁচাবে। সঙ্গে এটি দিয়ে দ্রুত ও কোনরকম জটিলতা ছাড়াই গ্রাহককে তার আকাঙ্ক্ষিত সেবাটি দেয়া যাবে। অনুমোদনের বিভিন্ন পর্যায় থাকলে সেখানে অনলাইনেই আবেদনের বর্তমান অবস্থাটা সম্পর্কে জানা যাবে।
তবে ঢাকা ও বাংলাদেশ এবং এসব এলাকার মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে অবিলম্বেই ভবিষ্যতে নিম্নলিখিত জিনিসগুলো অবশ্যই পালন করতে হবেঃ
- জাতীয় বিল্ডিং কোড এর নিয়মিত হালনাগাদ ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ।
- বিল্ডিং অকুপেন্সি সার্টিফিকেট আবশ্যিক করা।
- নিরাপত্তা পরিদর্শক, অগ্নি নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও দমকলের লোকদের জন্য উন্নন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।
এটির ব্যাপারে সবাই একমত যে এদেশের মানুষের ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য বর্তমান আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন, সরকারী কতৃপক্ষের দ্বারা আইন পূর্নবহাল রাখা অতীব জরুরী। বাংলাদেশের প্রপার্টির বাজার একটি উদীয়মান ক্ষেত্র এবং রাজধানীর জমির প্রতি ইঞ্চি যেন সোনার মতই দামী।
তাই এটি অতীব জরুরি যে শুধু ঢাকা শহর নয়, সমগ্র বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন।
ঢাকা ও সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে জমির খোঁজ পেতে ভিজিট করুন Bikroy এর প্রপার্টি পোর্টালে। এবং এখানে অনুমোদিত বিক্রেতার কাছ থেকে কিনুন ফ্লাট, বাড়ি, এপার্টমেন্ট। তাই নিজের পরবর্তী আবাস কিংবা ব্যবসার জন্য ভিজিট করুন Bikroy.com পোর্টাল।