মৌসুমি আম : প্রকৃতির সেরা উপহার
চলছে মধুমাস। বাজার জুড়ে টসটসে পাকা আর টাটকা ফলের মেলা, তার মোহনীয় সুবাসে জিভে জল না এসে উপায় নেই! ফলের দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন আর এই ফলের দিকে চোখ পড়েনি বা ২-১ কেজি কিনে ব্যাগবন্দী করেননি এমনটা হতেই পারে না। জ্বি, বলছি দেশের সবচেয়ে সুস্বাদু আর জনপ্রিয় ফলের কথা, সবার প্রিয় ফলের রাজা আম। এটা সবার জানা যে এই সময়টাই বেশি বেশি সুস্বাদু আম কেনা আর গাছপাকা আমের স্বাদে বিভোর হবার শ্রেষ্ঠ সময়। তবে সেজন্য আপনাকে বাজারের সেরা আম সবচেয়ে ভালো অবস্থায় কিনতে হবে, যেটা হয়ত সবাই ঠিকমত পেরে ওঠেন না।
আজ আমরা আপনাকে এমন কিছু টিপস দিতে চাই যাতে করে আপনারা বেশ কিছু জাতের আমের ভিড়ে খুঁজে সবচেয়ে ভালো আমগুলো বাছাই করতে পারেন আর ভালোভাবে পাকা আমের স্বাদ নিতে পারেন। একই সাথে আমরা এই মহামারির সময়ে কীভাবে ঘরে বসে থেকেই অনলাইনে আম অর্ডার করতে পারবেন তা নিয়ে আলোচনা করব। তবে আর দেরি কেন, চলুন শুরু করি!
রঙ দেখেই যাচাই নয়!
আমরা সকলেই কমবেশি ছোটবেলায় আমের ছবি এঁকেছি আর বেশিরভাগ সময়ই শিক্ষকরা আমাদের শিখিয়েছেন যে সবুজ আম হলো কাঁচা এবং টক, আর পাকা আম বাইরে থেকে দেখতে হলুদ, কমলা কিংবা হাল্কা লালের ছোপ রঙের। কিন্তু এ কথা মোটেও সত্যি নয়। সব আমের রঙ যেমন এক হয়না, তেমনি আমের রঙ দেখেও সেটা কতটা পাকা তা বোঝা যায় না।
আমের জাত, মৌসুম আর কোন পরিবেশে জন্মেছে এর ভিত্তিতে আমের রঙ আর স্বাদ অনেকটাই আলাদা হতে পারে। এমন কিছু আম আছে যা দেখতে বাইরে থেকে সবুজ, কিন্তু স্বাদে বাজারের অন্যসব আমের চেয়ে অনেক মিষ্টি আর সুস্বাদু। অতএব কেবল রঙ দেখে আম বাছাই করতে যাওয়াটা একেবারেই বোকামি!
বাহ্যিক চেহারা আর চামড়ার অবস্থা বলতে পারে ভেতরের খবর
যে আমটি কিনতে চাচ্ছেন সেটি ভালোভাবে হাতে নিয়ে পরীক্ষা করুন আর হাল্কা টিপে দেখুন। ভালো মানের সঠিকভাবে পাকা আম কিছুটা নরম অনুভব হয়, তবে একেবারে তুলতুলেও নয় কেননা এর মানে আমটি বাইরের চাপে ঢিলে হয়ে গেছে আর একে সুন্দরভাবে কেটে খাওয়া সম্ভব নয়। আমের খোসা বা চামড়া টানটান হওয়া উচিত।
বোঁটার আশেপাশে হাল্কা দাগ থাকাটা প্রাকৃতিক আর গাছপাকা আমের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু খোসা যদি খুব বেশি ঢিলে, টোল পড়া, গর্ত হয়ে থাকা বা কিছু যায়গায় ফাটা থাকে এর মানে হচ্ছে আমটি বেশি পেকে গেছে বা নষ্ট হবার পথে। যদি দিনে দিনে আম খেয়ে ফেলতে চান তাহলে একটু নরম দেখে আম কিনলে ক্ষতি নেই, কিন্তু কিছুদিন রেখে খেতে চাইলে বেছে বেছে একটু শক্ত দেখে নেয়া ভালো।অনলাইনে আম অর্ডার করার ক্ষেত্রে বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করে নিয়ে দেখতে পারেন অথবা ছবি চেয়ে নিয়ে নিজেই পরখ করে দেখতে পারেন।
নাককে বিশ্বাস করুন!
আম দেখতে যেমনই হোক না কেনো, এর ঘ্রাণই আপনাকে বলে দেবে আমটি ভেতরে কতটুকু পাকা আর রসালো। উত্তমরুপে গাছপাকা আমের মিষ্টি রমরমা সুঘ্রাণ কখনো মিথ্যে বলে না। বোঁটার কাছাকাছি এই ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়, অতএব হাতের ছোঁয়ায় আম শক্ত মনে হলে যাচাই করার জন্য আমের বোঁটার দিকটা শুঁকে দেখুন। আবার কেমিক্যাল দেয়া আমগুলো অনেক সময় শুঁকেই সনাক্ত করা যায়, এক্ষেত্রে আমের ঘ্রানের সাথে কার্বাইন বা ফরমালিনের কড়া গন্ধ টের পাওয়া যায়।
প্রাকৃতিকভাবে উচ্চপরিমানে চিনিজাতীয় উপাদান থাকার কারনে গাছপাকা কেমিক্যালমুক্ত আম খুব অল্প সময়েই পচে যায়, যেকোনো টকটক বা বোটকা গন্ধ থাকলে ধরে নিতে হবে যে আমটি নষ্ট হয়ে গেছে।
আধপাকা আমকে ঘরে রেখে পাকানো যায়
ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যদি আপনি কিছু কাঁচা বা আধপাকা আম কিনে ফেলে থাকেন, তবে সেগুলো টেবিলের ওপর বা যেকোনো উঁচু পরিষ্কার যায়গায় ছায়া বা একটু ঠাণ্ডা পরিবেশে রেখে দিন। সাধারনত দুই থেকে চার দিনের মধ্যেই আধপাকা আমগুলো নরম আর খাওয়ার উপযোগী হয়ে যায়। কাঁচা হলে হয়ত পাকতে কিছুদিন বেশি সময় লাগতে পারে। যদি রুমের ভেতর তাপমাত্রা অনেক বেশি হয় তাহলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাড়াতাড়ি আম পেকে যায় বা অনেক সময় নষ্টও হয়ে যায়। একবার ভালোভাবে পাকার পর আম ফ্রিজে রেখে দিলে আরো চারদিন পর্যন্ত ভালো রাখা সম্ভব।
কাঁচা থেকে ঘরে রেখে পাকানো আম নষ্ট না হলেও খেতে টক লাগতে পারে। এর কারন হয়ত আমগুলো গাছ থেকে বেশি আগেই পেড়ে নেয়া হয়েছে। এধরনের আম অনেকের কাছে খেতে ভালো নাও লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে সাথে লবন, চিনি বা অন্য যেকোনো রকম মশলা মিশিয়ে ব্লেন্ডারে জুস বানিয়ে ভিন্ন স্বাদে আম খাওয়া যায়। আমি নিজে যখনই এমন টকমিষ্টি আম পাই, একটু চিনি, লবন আর গুঁড়ো মরিচ মিশিয়ে খেতে দারুন লাগে।
খাওয়ার আগে ভালোভাবে ধুয়ে নেয়া জরুরি
আচার বানানোর সময় খোসাসহ রান্না করা হয় বলে ভালোভাবে ধুয়ে নেয়া উচিত, তবে স্বাভাবিকভাবে খোসা ছাড়িয়ে খাওয়ার আগেও আমের বাইরের দিকটা ভালোভাবে ধুয়ে নেয়া খুব জরুরি। কেমিক্যাল অথবা জীবানুর কিছু অংশ খোসার উপর থেকে যায়, যা কিনা ফল কাটার সময় ভেতরে চলে যেতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে আমের খোসা খাওয়া যায় আর দেশ বিদেশে অনেকেই খোসাসহ আম খেতে পছন্দ করেন। আমের খোসায় এমন কিছু পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা আমাদের শরীরে পিপিএআর নামক রিসেপ্টর অনুগুলো নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যা আমাদের শরীরে কোলেস্টেরল আর গ্লুকোজ এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে আর এতে রয়েছে বেশ কিছু ক্যান্সার-ধ্বংসকারী গুনাগুন। অতএব আপনিও যদি আমের খোসা খেয়ে দেখতে চান তাহলে প্রথমে একে ভালোভাবে ধুয়ে নিন এবং আপেল কিংবা পীচ ফলের মত কামড়ে খেতে পারেন।
এছাড়াও যদি আমে কোনরকম কেমিক্যাল যেমন ফরমালিন বা কীটনাশক আছে এমন সন্দেহ হয়, তাহলে খাওয়ার আগে আমগুলো ধুয়ে বোলভর্তি পরিষ্কার পানিতে কমপক্ষে আধঘন্টা চুবিয়ে রাখুন। এতে করে কেমিক্যালগুলো পানিতে দ্রবীভূত হয়ে ফল থেকে আলাদা হয়ে যাবে। আর আপনারা নিশ্চিন্তে আমগুলো কেটে খেতে বা পরিবেশন করতে পারবেন।
এই মৌসুমের সেরা আমগুলো চিনুন
এই মৌসুমের সেরা আমের জাতগুলো হলো ‘হিমসাগর’, ‘ক্ষিরসাপাত’, ‘ল্যাংড়া’ ইত্যাদি। এদের মধ্যে সবচেয়ে মিষ্টি আর সুস্বাদু হলো হিমসাগর আম। একে কেটে কিংবা বা জুস বানিয়ে খাওয়া যায়, স্বাদে সবরূপেই অতুলনীয়।
ছোট-বড় সব বয়সের মানুষ এ খাবারটি পছন্দ করেন আর এই ভাবে ভাতের সাথে খাবার জন্য হিমসাগর আর ক্ষিরসাপাত আম সেরা। যারা বড় মাংসল আর সুঘ্রাণে ভরা আম পছন্দ করেন, তাদের জন্য ল্যাংড়া আম সবার আগে প্রিয়। এগুলো ছাড়াও আরো বিভিন্ন জাতের আম বাজারে রয়েছে। আপনার চাহিদামতো পছন্দের আমটি নিয়ে অনলাইনে সার্চ করে জেনে নিতে পারেন অনেক কিছু, আর সেরা অভিজ্ঞতার জন্য যেকোনো মৌসুমে মৌসুমি ফল খাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো।
কোন আম কখন খাবেন
সময় অনুযায়ী বাংলাদেশের আমকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়- আগাম জাত, মধ্য মৌসুমি জাত, এবং নাবি জাত। মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাজারে উঠে আগাম জাতের আম। এই আমগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ রাণীপছন্দ, গোবিন্দভোগ, গোপালভোগ, এবং বৃন্দাবনি। আবার মধ্য জুন থেকে বাজারে পাবেন মধ্য মৌসুমি জাতের আম, যাদের মধ্যে জনপ্রিয় হলোঃ ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাত, লক্ষণভোগ, হাঁড়িভাঙ্গা, হিমসাগর, সূর্যপুরি ইত্যাদি।
অন্যদিকে নাবি জাতের আমগুলো সাধারণত জুলাই এর শুরু থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাজারে উঠে থাকে, যার মধ্যে রয়েছে- ফজলি, আম্রপালি, আশ্বিনা, গৌড়মতি, বোম্বাই ইত্যাদি।
আমের নানান ব্যবহার
আম কাঁচা হোক কিংবা পাকা, সারা বিশ্বে খাবারের বিভিন্ন পদ রান্নায় আম ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কাঁচা আম দিয়ে আচার, জ্যাম, চাটনী, আমচুর, আমসত্ত্বসহ নানা রকম সাইড-ডিশ তৈরি করা হয়। এই কাঁচা আম ছিলে কুচি করে লবন, চিনি আর মরিচ মিশিয়ে ভর্তা করেও খাওয়া যায়। পাকা আম দিয়ে জেলী, জুস, মোরব্বা তৈরি সহ বিভিন্ন জিনিসে ফ্লেভার হিসেবে ব্যবহার করা যায়, যেমন- আইসক্রিম, ফালুদা, কাস্টার্ড, আমদুধ ইত্যাদি। ছোট থেকে বড় সকলে এই মিষ্টি, রসালো ফলটি খুব ভালোবাসে আর তাই নিঃসন্দেহে প্রকৃতির এই সেরা উপহার, আম বাংলাদেশের সকল ফলের রাজা।
শেষ কথা
আমের প্রতি আমাদের ভালোবাসা জীবনের নানা কর্মকান্ডের সাথে মিশে একীভূত হয়ে আছে। দেশের নানা প্রান্তের উৎকৃষ্ট জাতের আম নিয়ে গর্বের যেন শেষ নেই আমাদের। এরূপ ভাবনা তৈরি হয়েছে আমাদের আঞ্চলিকতা এবং দেশাত্মবোধ থেকেই। তাই আর দেরই নয়, এই মৌসুমের শুরু থেকেই পছন্দের জাতের আম পেতে এবং অনলাইনে আম অর্ডার করতে খোঁজ রাখতে পারেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মার্কেটপ্লেস Bikroy.com-এর বিশ্বস্ত আম বিক্রেতাদের অনলাইন শপগুলোয়!
সঠিক সময়ে সচেতনভাবে আপনার পছন্দের আম ক্রয় করুন এবং বিষমুক্ত আমের প্রভাব থেকে নিজেকে ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিরাপদ রাখুন।