বহনযোগ্য ল্যাপটপ ক্রেতার জন্য নির্দেশনা

ল্যাপটপ এখন আর কোন ব্যয়বহুল, বিলাস পণ্য নয়। সাম্প্রতিক সময়ে সাশ্রয়ীমূল্যের একটি বহনযোগ্য ব্যক্তিগত ল্যাপটপ না থাকার কোন কারনই নেই, বরং থাকাটাই স্বাভাবিক। নিচের তথ্যগুলো ক্রেতাকে একটি ল্যাপটপের প্রধান ফিচার, ভার্সন ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য জানতে সহায়তা করবে, এতে করে ক্রেতা নিজের প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে, নিজের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ল্যাপটপ বেছে নিতে পারবেন।
বর্তমানে বাজারে ক্রেতার জন্য বাজারে বৈচিত্র্যময় ল্যাপটপ ও ব্যক্তিগত কম্পিউটার রয়েছে, যথা – ল্যাপটপ, আল্ট্রাবুক, নেটবুক, টাচস্ক্রিণ নোটবুক, পারফর্মেন্স নোটবুক, হাইব্রিড ল্যাপটপ, কনভর্টিবল প্রভৃতি। এতে করে ক্রেতা কোনটি কিনবে, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাই ল্যাপটপ কেনার আগে ক্রেতাকে বিবেচনা করতে হবে -ব্যাবসায়িক প্রয়োজন, গেম খেলা, না শিক্ষা কোন কাজের জন্য তিনি ল্যাপটপ কিনছেন?
সোশ্যাল মিডিয়া, ব্যবসা, শিক্ষা ও গবেষণা অথবা শুধুই ব্যক্তিগত ব্যবহার প্রভৃতি কারণে মানুষ ল্যাপটপ ক্রয় করে। বর্তমানে বাজারে পাওয়া যায় এমন সাম্প্রতিক স্টাইলের ল্যাপটপগুলোর উপর একটি পর্যালোচনা নিচে দেওয়া হলো।
নোটবুকসঃ
ব্যক্তিগত কম্পিউটারের উচ্চমান সংস্করণই নোটবুক। এটি সাধারণত ১১-১৭ ইঞ্চি আকারের পর্দার হয়। কারিগরি দিক থেকে সব ল্যাপটপই, নোটবুক হিসেবে বিবেচিত হয়।
নেটবুকসঃ
প্রাথমিকভাবে ইন্টারটে সার্ফিং এর জন্য নেটবুক তৈরি করা হয়েছে। এধরণের ল্যাপটপ দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি সহযোগে সহজেই বহনযোগ্য। এর দ্বারা প্রাথমিক কাজগুলো সম্পাদন করা যায়। এর পর্দার আকার ১০.১ ইঞ্চি বা তার চেয়ে কম হয়। এটি বহনেও খুবই হালকা, মাত্র ১.৫ কেজি ওজন।
আল্ট্রাবুকসঃ
আল্ট্রাবুক ইন্টেলের উদ্ভাবন, এটি তাদের কোম্পানির ট্রেডমার্ককে প্রতিনিধিত্ব করে। এ ধরণের ল্যাপটপের আকার সাধারণত ১১-১৫ ইঞ্চি হয়ে থাকে। এগুলো খুবই হালকা, পাতলা হয়ে থাকে। এগুলোকে হালকা ও বহনযোগ্য করার জন্য অধিকাংশ সময় এগুলোতে অপটিক্যাল ডিস্ক ড্রাইভ রাখা হয় না।
হাইব্রিডসঃ
এ প্রকারের ল্যাপটপের পর্দার আকার ১০ বা ১১ ইঞ্চি হয়ে থাকে। এগুলোতে স্পর্শযোগ্য পৃথক পর্দা থাকে, যেগুলো স্থায়ী ট্যাবলেট হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এর মধ্যে পরিপূর্ণ আকারের ব্যক্তিগত ল্যাপটপের উপকার পাওয়া যায়, পাশাপাশি ট্যাবলেটের মতো বহুমুখী ব্যবহারও করা যায়।
কনভার্টিবলস
কনভার্টিবলসের পর্দার আকার ১১ বা ১৩ ইঞ্চি হয়। এর সিঙ্গেল ইউনিটের মধ্যে পরিপূর্ণ আকারের কি-বোর্ড, স্পর্শযোগ্য পর্দা ও ট্র্যাক প্যাড রয়েছে, যার সাহায্যে এটিকে ইচ্ছানুযায়ী ট্যাবলেট ও ল্যাপটপে পরিবর্তন করা যায়।
এছাড়াও গ্রাফিক্স ডিজাইনার ও গেমারদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা স্পর্শযোগ্য পর্দা সম্বলিত টাচস্ক্রিণ নোটবুক ও পারফর্মেন্স ল্যাপটপ বাজারে আছে। উচ্চ মানের বিশেষ সুবিধাবলি সম্বলিত এসব পণ্যের দামও অনেক বেশি।
ল্যাপটপ কম্পিউটারের কী কী বিশেষত্ব থাকে সেগুলো জানা থাকলে, বাজার সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরি হবে। একটি ল্যাপটপ কেনার আগে যে বিষয়গুলো জানা দরকার, সেগুলো হচ্ছে-
১. প্রসেসরঃ
প্রসেসরকে আক্ষরিক অর্থে কম্পিউটারের ‘ব্রেইন’ বা ইঞ্জিন বলা যায়। বিশেষ ধরণের প্রসেসর বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়। তবে, বিষয়টি সব সময় এমন নয় যে, বড় প্রসেসর মানে ভালো প্রসেসর। ভালো মানের বেসিক ল্যাপটপের জন্য যুক্তিগ্রাহ্য বহনযোগ্য দামে ইন্টেল পেন্টিয়াম প্রসেসর, ইন্টেল কোর আইথ্রি, এএমডিই সিরিজের সডিল প্রসেসর বা ইন্টেল কোর আই৫ প্রসেসর কেনা যায়।
২. র্যাম (র্যান্ডম এক্সেস মেমোরিঃ
খুব ধীর গতির মেকানিক্যাল হার্ডডিস্ক ড্রাইভ ও দ্রুত গতির ইলেকট্রনিক প্রসেসরের মধ্যে সংযোগের যন্ত্র হিসেবে কাজ করে র্যাম। র্যাম হচ্ছে এমন ‘স্পেস’ যেখানে অস্থায়ী ডাটাগুলো জমা হয়, প্রতিবার কম্পিউটার বন্ধ করলে এই ডাটাগুলো ডিলিট হয়ে যায়। অধিকাংশ নোটবুক ২জিবি র্যামের হয়ে থাকে। যা মৌলিক কাজগুলো করার জন্যও খুবই ছোট বা স্বল্প। সেজন্য কমপক্ষে ৪জিবি র্যামের কম্পিউটার বাছাই করা শ্রেয়। পাওয়ার পারফর্মেন্স, গেমিং ও ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহারের জন্য কমপক্ষে ৮জিবি বা তার চেয়ে বেশি র্যাম নিতে হবে।
৩. হার্ড ডিস্ক ড্রাইভ- হোম অফ দি ডাটাঃ
বর্তমানে ৫০০জিবি হার্ড ডিস্ক ড্রাইভকে মানসম্মত বিবেচনা করা হয়। সুতরাং, বুঝতেই পারছেন, এর কম পরিমানের হার্ড ডিস্ক কেনা উচিত হবে না। এমনকি বর্তমানে গ্রাহকের বাজেট বান্ধব ল্যাপটপগুলোতেও ৫০০জিবি বা তার বেশি হার্ড ডিস্ক থাকে। যাইহোক, ভালো গতির জন্য ৭২০০ আরপিএম (হার্ড ড্রাইভ) প্রয়োজন, যদিও এটি খুঁজে পাওয়া মাঝে মাঝে কঠিন হয়ে পড়ে। ভালো পরিমাণ স্টোরেজ প্রয়োজন হলে ৭৫০জিবি থেকে এক টেরা বাইট (টিবি) হার্ড ড্রাইভ কিনতে হবে। এগুলোর মধ্যে দামের পার্থক্য খুবই কম। মনে রাখতে হবে যে, হার্ড ড্রাইভ কেনার সময় বড় হার্ড ড্রাইভ কেনা ভালো। যাতে করে, আপনার কম্পিউটারে সব সময় পর্যাপ্ত জায়গা থাকে ও দ্রুতগতিতে চলে।
৪. এসএসডি-সলিড স্টেট ড্রাইভঃ
এসএসডি হচ্ছে সলিড পারফর্মেন্স স্টোরেজ। এটি সাধারণত মূল্যবান আল্ট্রাবুকে পাওয়া যায়। মূলত এটি হচ্ছে ইলেকট্রনিক স্টোরেজ ডিভাইস যা সফটওয়্যার লোড, অ্যাক্সেস ডাটা, রিজ্যুম ও স্টার্টআপকে গতিশীল করে। এটি ব্যাটারির ব্যাকআপ বৃদ্ধি করে ও কম্পিউটারের ওজন কমিয়ে দেয়। অসুবিধার বিষয় হচ্ছে, এর জন্য স্টোরেজ ও দামের ক্ষেত্রে সমঝোতা বা কম্প্রোমাইজ করতে হয়। বাজারে এখনো প্রতি জিবি এসএসডি’র দাম তুলনামূলক বেশি। জায়গার চেয়ে গতিকে প্রাধান্য দিতে চাইলে এসএসডি নেয়া যায়। প্রাথমিকভাবে ১২৮জিবি, ২৫৬জিবি ও ৫১২জিবি ল্যাপটপে এসএসডি পাওয়া যায়। এর দাম খুব বেশি।
৫. ডিসপ্লেঃ
পর্দার আকারের উপর ভিত্তি করে অনেকে প্রাথমিকভাবে ল্যাপটপ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। পর্দা বড় বা ছোট হওয়াতে কোন পার্থক্য নেই। পর্দার আকর্ষণ ও ছবির স্পষ্ঠতা নির্ভর করে রেজ্যুলেশনের উপর। অধিকাংশ ল্যাপটপের পর্দার রেজ্যুলেশন হচ্ছে ১৩৬৬*৭৬৮ পিক্সেলস। তবে, এখন কোন কোন মডেলে এর চাইতে বেশি আকারের পিক্সেলও পাওয়া যায়। পরিপূর্ণ এইচডি পর্দায় খুব ভালোভাবে গেমিং ও মুভি দেখা যায়, কিন্তু এটি খুবই দামী। শিক্ষার উদ্দেশ্যে ল্যাপটপ ব্যবহার করার জন্য খুব বেশি রেজ্যুলেশনের প্রয়োজন নেই।
৬. গ্রাফিক্স চিপঃ
ভিডিও বা মুভি দেখা, কিছু গেম খেলা ও ইন্টারনেট সার্ফিং এর মতো মৌলিক কাজগুলো করার জন্য গ্রাফিক্স চিপই যথেষ্ট। কিন্তু, পেশাদার ভিডিও ও ফটো এডিটিং, উচ্চ মানের গেম খেলা বা গ্রাফিক্যাল থ্রিডি কাজের জন্য আলাদা গ্রাফিক্স মেমোরি সম্বলিত গ্রাফিক্স প্রসেসর প্রয়োজন হবে। এছাড়াও, একটি আলাদা গ্রাফিক্স প্রসেসর অনলাইন-অফলাইন উভয় ক্ষেত্রে ভিডিও প্লেব্যাককে গতিশীল করে। মনে রাখতে হবে, যতবেশি আলাদা মেমোরি থাকবে, ততবেশি ভালো পারফর্মেন্স হবে। বেসিক শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপের জন্য সংযুক্ত গ্রাফিক্স কার্ডটিই যথেষ্ট। যারা ভিডিও এডিটিং বা মজা করার জন্য খুবই সাধারণ ভিডিও গেম খেলতে চায় তাদের জন্য অ্যাড-অন বা আলাদা গ্রাফিক্স কার্ড না হলেও চলে।
৭. এক্সট্রাঃ
বেশিরভাগ মানুষের জন্য দুইটি ইউএসবি পোর্টস যথেষ্ট নয়। বর্তমানে অধিকাংশ ল্যাপটপে তিনটি বা ততোধিক ইউএসবি সংযোজনের সুযোগ আছে। কম্পিউটারকে মনিটর বা এইচডিটিভি’র সাথে যুক্ত করার জন্য এইচডিএমআই পোর্ট থাকাই যথেষ্ট।
অন্যান্য বিবেচ্য ফিচারগুলোঃ
কেনার আগে উৎপাদকের কাছ থেকে অপারেটিং সিস্টেম সম্পর্কে জানার সাথে সাথে ল্যাপটপের ব্যাটারির স্থায়ীত্ব সম্পর্কেও জেনে নিতে হবে। বেশিরভাগ বহনযোগ্য ল্যাপটপে ডস (ডিওএস) থাকে। সুনামধন্য উৎপাদকের কাছ থেকে ল্যাপটপ কিনতে হবে। এতে করে সমস্যা দেখা দিলে ভালো টেকনিক্যাল সহায়তা পাওয়া যাবে।
ইন্টারনেট সিকিউরিটিঃ
যে কোন স্টাইল বা ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ কিনুন না কেন, এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে ইন্টারনেট সিকিউরিটি। যে কোন ধরণের ডাটা হারানো, ক্র্যাশ বা সিকিউরিটি ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেতে ভালো মানের ইন্টারনেট সিকিউরিটি ইনস্টল করতে হবে।
যদি একজন শিক্ষার্থী তার জন্য একটি আদর্শ ল্যাপটপের খোঁজে থাকে, তাকে প্রথমেই নিজের স্কুলের কোর্সের জন্য কী ধরণের সিস্টেমের প্রয়োজন সেটি জানতে হবে। সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি বেসিক ল্যাপটপই যথেষ্ট। সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সবার আগে নিজের প্রয়োজন জানতে হবে, সেই অনুযায়ী উপযোগী সিস্টেম বেছে নিতে হবে।