ফ্যাশন, স্বাস্থ্য এবং সৌন্দর্য্য

কোভিড-১৯ঃ কীভাবে নিজেকে এবং অন্যদের নিরাপদ রাখবেন?

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকদের মতে, প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকার কারণে খুব শীঘ্রই বাংলাদেশ এই মহামারির ৩ নম্বর ধাপে পৌঁছে যাবে। সামনের দিনগুলো আমাদের সবার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ একটা দেশ যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১,১১৬ জন মানুষ বাস করে, সেখানে আমাদের জন্য আগামী কয়েক সপ্তাহে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ কমানোর ক্ষেত্রে বেশ কঠিন চ্যালেঞ্জই অপেক্ষা করছে।  

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া এই দুঃসময় আমাদের একটা বিড়ম্বনার মুখে ফেলে দিয়েছে যে আসলেই এই ভাইরাস নিয়ে চিন্তিত হবার সময় হয়েছে কিনা, এবং এই ক্ষুদ্র ভাইরাসের হুমকিকে গুরুত্ব সহকারে না দেখার পরিণাম কতটা ভয়ংকর হতে পারে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং আক্রান্তদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যেহেতু এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে খুব কম লক্ষণই প্রকাশ পায় কিংবা প্রায় ২-৩ সপ্তাহ পরে গিয়ে হঠাৎ লক্ষণ দেখা দেয়, সুতরাং নিজের অজান্তেই কতজন যে বাহক হিসেবে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাচ্ছেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া মুশকিল।

সৌভাগ্যবশত, অনেক বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞই এটা বলেছেন যে সবাই সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই রোগ ছড়ানো কমতে এমনকি সম্পূর্ণরূপে ছড়ানো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। শুধুমাত্র নিয়মিত হাত ধোয়ার মত সহজ একটি অভ্যাস যে কিছু সময়ের ব্যবধানেই সংক্রামিত লোকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনতে পারে তা বিস্ময়করই বটে। এরকম বৈশ্বিক সংকটের সময় নিজেকে এবং পরিবারকে নিরাপদে রাখার প্রক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপলব্ধ ঘটনার কোনটি সঠিক আর কোনটি নয় সেটা আমাদের যাচাই করতে হবে।

কোভিড-১৯ এর লক্ষণ বা উপসর্গ কীভাবে চিনবেন?

চিন্তার বিষয় হলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে খুব কমই লক্ষণ প্রকাশ পায় আবার অনেক সময় তা একদমই প্রকাশ পায়না। অর্থাৎ আক্রান্তদের সবার হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন নাও হতে পারে। করোনাভাইরাস মূলত একটি শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ যার কিছু লক্ষণ হলো জ্বর, ক্লান্তি, শুকনো কাশি ইত্যাদি। এছাড়াও অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা, গলাব্যথা, মাথাব্যথা, বুকেব্যথা, এবং কদাচিৎ ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব এবং নাক দিয়ে পানি পড়তেও দেখা যায়। ষাটোর্ধ ব্যক্তি এবং আগে থেকেই বিভিন্ন শারীরিক ভুগছেন এমন ব্যক্তিরা সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে আছেন। WHO এর মতে, স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিদের মধ্যে এই রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্র সেলফ আইসোলেশন বা নিজেকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে।

সামাজিক দূরত্ব কী?

ইতোমধ্যেই আমরা অনেক বড় বড় অনুষ্ঠান এবং আয়োজনই বাতিল হতে দেখেছি। এমতাবস্থায় সামাজিক দূরত্বের গুরুত্ব আমাদের সবাইকে অনুধাবন করতে হবে। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বা সামাজিক দূরত্ব এর অর্থ হলো ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আশেপাশে অপর মানুষদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকা। নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যে পাশে থাকা মানুষদের সাথে কমপক্ষে ৩ ফিট বা ১ মিটার দূরত্ব বজায় রাখলে এবং জনসমাগম আছে এমন জায়গা পরিহার করলে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্য হারে কমানো যায়। 

সামাজিক দূরত্ব পালনের অংশ হিসেবে সারা বিশ্বে যেসব ব্যবস্থা এরই মধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে তা নিম্নরূপঃ   

  • সকল ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া,
  • অনলাইনে শিক্ষাগ্রহণ এবং শিক্ষাপ্রদান কার্যক্রম চালানো,
  • অফিস-আদালত বন্ধ করে দেওয়া,
  • ঘরে থেকে অফিসের কার্যক্রম পরিচালনা করা,
  • রোটেশন বা পালাক্রমে কর্মীদের মাধ্যমে অফিস পরিচালনা করা যাতে খুব বেশি মানুষের সমাগম না হয়,
  • বন্ধুবান্ধব এবং নিকটাত্মীয়দের সাথে সরাসরি দেখা না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খোঁজ খবর নেওয়া।

কীভাবে স্ব-বিচ্ছিন্নতা অনুশীলন করবেন

অনেকেই এমনটা মনে করে থাকেন, সেলফ-কোয়ারেনটাইন বা স্ব- বিচ্ছিন্নতা কেবল যারা  অসুস্থ হয়ে পড়ে তাদের জন্য। কিন্তু আপনি যদি দেশের বাহির থেকে এসে থাকেন অথবা প্রায়শই আপনার বাহিরে আসা যাওয়া থাকে এবং বিশেষত আপনি যদি কিছুদিনের মধ্যে বাহির ভ্রমণ করে আসেন সেক্ষেত্রে আপনার মাঝে কোনোরকম লক্ষণ দেখা না দিলেও আপনার সেলফ-কোয়ারেনটাইন বা স্ব-বিচ্ছিন্নতায় থাকা উচিৎ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কমপক্ষে ১৪ দিনের বিচ্ছিন্নতায় থাকা, যাতে করে আপনি সংক্রামিত কিনা তা জানা যায়।

  • স্ব- বিচ্ছিন্নতার জন্য সেরা অনুশীলন:
  • ঘরে থাকা, 
  • অতিথি আপ্যায়নে বিরত থাকা,
  • পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, 
  • ঘন ঘন হাত ধোয়া,
  • আলাদা তোয়ালে এবং খাবার পাত্র ব্যবহার করা,
  • নিয়মিতভাবে দরজার হাতল এবং সুইচ বোর্ডগুলোতে জীবাণুনাশক ব্যাবহার করা, 
  • দিনে একবার অ্যালকোহল প্যাড দিয়ে আপনার মোবাইল এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস পরিষ্কার করা,
  • জুতো ঘরের বাইরে রাখা,
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে পানীয় পান করা এবং ভিটামিন সি গ্রহণ বাড়ানো।

আর কি করতে পারি?

এই নতুন করোনাভাইরাসটিকে  এত বেশি মারাত্মক হয়ে উঠেছে ‌যে এটি অতি দ্রুত মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপুল সংখ্যক লোকের মাঝে এর লক্ষণগুলির অনুপস্থিত। ভাইরাসটি সংক্রামিত ব্যক্তির মধ্যে দ্রুত প্রজনন করে।  এমনকি সংক্রামিত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি অথবা তার স্পর্শকৃত বস্তুটি স্পর্শ করে যদি আপনি আপনার মুখমন্ডল স্পর্শ করেন তাহলে আপনিও এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হতে পারেন। 

এতেই বোঝা যাচ্ছে, বিপুল সংখ্যক আক্রান্ত মানুষ না জেনেই এই ভাইরাসটি অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অতএব এই মহামারিকে ধীর করার উপায় নির্ভর করছে আমাদের উপর। আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে এবং গ্রহণ করতে হবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। অনেক দেশই এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ লকডাউনে চলে গেছে।  ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ হচ্ছে বা অস্থায়ীভাবে বন্ধ রয়েছে। রাস্তাগুলি একদম ফাঁকা। তবে বাংলাদেশেও সরকারিভাবে ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এখনও অনেক লোক দেখা করছেন বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের সাথে এবং এর মাধ্যমে অন্যকে বিপদে ফেলছেন। এগুলো সম্পূর্ণরূপে এড়ানো উচিত। মুদি দোকান বা ব্যাংক এ যাওয়ার মতো অতি প্রয়োজনীয় কাজগুলো হয়তো এড়ানো যায় না, সে ক্ষেত্রে কয়েকটি সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে:

  • জনসমাগম এ মাস্ক ব্যবহার করা,
  • হাঁচি বা কাশি এলে টিস্যু ব্যবহার করা এবং এটি নিরাপদ স্থানে ফেলা,
  • বাহিরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা,
  • অর্থের লেনদেন ও এটিএম ব্যবহার করার সময় গ্লাভস বা খাম ব্যবহার করা,

অসুস্থ হয়ে পড়লে কী করবেন?

এত সতর্কতা অবলম্বন করার পরেও অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছে করোনাভাইরাসে অথবা দেখা দিচ্ছে এর লক্ষণ সমূহ। কিন্তু আশার ব্যাপার হচ্ছে, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সংক্রামিত বেশিরভাগ লোক বিশেষ চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে উঠবেন। আপনি যদি সন্দেহ করে থাকেন আপনার করোনাভাইরাস থাকতে পারে সেক্ষেত্রে আপনার করনীয়ঃ  

  • ঘরেই অবস্থান করুন
  • ডাক্তারের পরামর্শ নিন,  হোম কোয়ারেনটাইন এর নির্দেশাবলী অনুসরণ করুন,
  • আপনার যদি জরুরি অবস্থা দেখা দেয় তবে আপনার স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করুন:

o   শ্বাস নিতে অসুবিধা,

o   বুকে ক্রমাগত ব্যথা বা চাপ অনুভব করা,

o   নড়াচড়া করতে সমস্যা বা অক্ষমতা,

o   নীল বর্ণের ঠোঁট বা মুখ।

ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন 

পৃথিবী গত শতাব্দীতে যা কিছু দেখেছিল কোভিড-১৯ মহামারি তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এর মাধ্যমে বিশ্বে একটি জরুরি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, যা পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশগুলোকে খুব অল্প সময়ে আক্রান্ত করেছে। তবে এটি সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি আমরা প্রত্যেকের জায়গা থেকে আমাদের দায়িত্বটুকু পালন করি এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে চলি। এই ভাইরাসটি যতই মারাত্মক হোক না কেন, আমরা যদি এর দ্রুত ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে পারি তবে এটি বেশিদিন টিকতে পারবে না। যেহেতু এই রোগটি আমাদের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়ায় সুতরাং যথাসাধ্য চেষ্টার মাধ্যমে একে অপরের কাছ থেকে দূরে থাকা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য কিছু প্রাথমিক নিয়মাবলি অনুসরণ করতে হবে। যাতে করে আমরা আমাদের দেশ – এবং বিশ্বকে – পুনরায় এই মহামারিতে আক্রান্ত হওয়া থেকে ফিরিয়ে আনতে পারি। আমরা আশা করি যে আপনি এই লেখাটি  আপনার ঘরে নিরাপদ অবস্থান থেকে পড়ছেন, পরিষ্কার থাকছেন, আপনার শখগুলোতে মনোনিবেশ করছেন এবং প্রত্যেকের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দূর থেকে কাজ করছেন।

Facebook Comments
সাবস্ক্রাইব করুন

No spam guarantee.

Show More

Related Articles

Back to top button
Close
Close