সরকারি চাকরি প্রস্তুতির আদ্যোপান্ত
দেশের তরুণ সমাজের কাছে বহুল আলোচিত এক প্রশ্ন হলো, “কোচিং ছাড়াই কিভাবে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে?” যা থেকে সরকারি চাকরির প্রতি আমাদের দুর্নিবার আকর্ষণ সহজেই অনুমেয়। আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা সমাপ্ত করার পর অনেকেই নিজের ভাগ্যকে ঝালিয়ে দেখার জন্যে হলেও সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে থাকেন।
বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা অনার্সের পর একজন প্রার্থীর কাছে বেশ কিছু চাকরির দরজা খোলা থাকে। যার মধ্যে রয়েছে এমএনসি, ব্যাংক, প্রাইভেট কোম্পানি, আইটি ফার্ম, সহ নানা বেসরকারি ও সরকারি চাকরি। এর প্রায় প্রতিটি চাকরিই ভালো স্যালারি সহ যাবতীয় অন্যান্য সুবিদাধি প্রদান করলেও, সরকারি চাকরির প্রতি আমাদের টান বরাবরই বেশি।
আজকের লেখায় আমরা কিভাবে এবং কি কি উপায় অবলম্বন করে বাংলাদেশে সরকারি চাকরি পাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া যাবে সে ব্যপারে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরির পরীক্ষা
বর্তমানে শুধুমাত্র সরকারি চাকরির-ই এক বিশাল পরিসর রয়েছে আমাদের দেশে। একজন চাকরিপ্রার্থী বিসিএস, সরকারি ব্যাংক, প্রাইমারি, এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ভিত্তিক চাকরিসহ অন্যান্য সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতে পারেন। প্রায় বছর জুড়েই হতে থাকে এসব সরকারি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি।
তবে এসব চাকরি পরীক্ষার মধ্যে মূল পার্থক্য হলো পরীক্ষার ধরণ এবং নাম্বার বণ্টনে। সুতরাং আপনার জন্য সঠিক চাকরিটি নির্ধারন করার পর পরবর্তী অংশে আলোচনাকৃত প্রস্তুতির ধরণ অনুসরণ করার মাধ্যমে নিজেকে এগিয়ে রাখতে পারেন।
কিভাবে বাসায় বসেই নেওয়া যাবে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি?
অনেক চাকরিপ্রার্থীরা সহ দেশের অনেক ছাত্রছাত্রীরাও সঠিক উপায়ে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ার গাইডলাইনের অভাবে ভুগে থাকেন। এমনকি অনেকেই সঠিক উপায়ে প্রস্তুতি না দেওয়ার দরুন একের পর এক পরীক্ষা দিয়েও সাফল্যের ছোঁয়া পাননি।
শুধুমাত্র কঠোর পরিশ্রমই নয়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ এবং গোছানো প্রস্তুতি এই তিনটির সংমিশ্রনেই আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন। চলুন দেখে নেয়া যাক কিভাবে সঠিক উপায়ে ঘরে বসেই সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব।
আপনার গন্তব্য নির্ধারণ করুন
প্রস্তুতি শুরুর প্রাথমিক পর্যায়েই আপনার গন্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিন। অনেকেই আছেন যারা মাত্র একটি চাকরিকে মাথায় রেখে তাদের প্রস্তুতি নিচ্ছেন আবার অনেকে একাধারে বেশ কিছু লক্ষ ঠিক করে রেখেছেন। যদিও এটা সম্পূর্ণ ভাবে প্রার্থীর মানসিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করছে।
তবে তিনটির বেশি আলাদা আলাদা ক্ষেত্র নির্বাচন করলে আপনার প্রস্তুতিতে ঘাটতি থেকে যেতে পারে। সুতরাং বিসিএস, সরকারি ব্যাংক, মন্ত্রণালয় ভিত্তিক বিভিন্ন চাকরির মাঝ থেকে নির্দিষ্ট একটি বা দুটি চাকরি বেছে নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করুন। পাশাপাশি এমন দুটি অথবা তিনটি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকুন যাদের সিলেবাসের মধ্যে মিল রয়েছে, এতেকরে আপনি সেগুলোর মধ্যে আপনার সময় ও শ্রম সঠিক উপায়ে ভাগ করে দিতে পারবেন।
পরীক্ষার ধরণ এবং সিলেবাস সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে
পছন্দের চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহনের জন্য যোগ্য হলে তার সিলেবাস এবং প্রশ্নের ধরণ সম্পর্কে ভালো ভাবে ধারণা নিন। এতেকরে আপনাকে কি কি বিষয়ের উপর প্রস্তুতি নিতে হবে তা জানতে পারবেন।
বেশ কিছু সরকারি চাকরির সিলেবাস একইরকম হয়ে থাকে। যেমন আপনাকে বাংলা/ইংরেজি (সাহিত্য), সাধারণ গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান, এবং সাধারণ জ্ঞান (বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক) বিষয়ের উপরে প্রস্তুতি নিতে হবে বেশিরভাগ চাকরির ক্ষেত্রেই।
সুতরাং প্রস্তুতির গোড়া থেকেই একটি সর্বজনীন প্ল্যান করে নিন যা সকল বিষয়ের উপর সমান গুরুত্ব দিতে সহয়তা করবে। এছাড়াও এভাবে প্রস্তুতি নিলে আপনি আসন্ন যেই পরীক্ষাটি রয়েছে তার উপর বেশি জোর দিতে পারবেন সহজেই। ধরা যাক, আপনি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবং বিসিএস এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এর মধ্যে আগামী মাসে ব্যাংকের পরীক্ষার তারিখ থাকলে আপনি সহজেই শুধুমাত্র ব্যাংকের পরীক্ষার কথা মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিতে পারবেন।
সর্বোচ্চ দিয়ে প্রস্তুতি নিন
“কিভাবে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিব?” এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দিতে হলে আমরা বলব, যতগুলো সম্ভব মক টেস্টে অংশ নিন। তবে মক টেস্ট দেওয়ার আগে সবগুলো বিষয়ের উপর ভালো দক্ষতা থাকা প্রয়োজনীয়।
- প্রিলিমিনারি প্ররীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে সহজ বিষয়গুলোর উপরে জোর দিন এবং দ্রুততার সাথে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করুন।
- লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে তুলনামূলক কঠিন বিষয় এবং গণিতের উপরে দক্ষতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে।
- প্রস্তুতির সময়ে প্রয়োজনীয় সমস্ত উপকরণ সাথে আছে কিনা নিশ্চিত হয়ে নিন।
মক টেস্টের প্রয়োজনীয়তা
সরকারি চাকরির একটি সামগ্রিক প্রস্তুতির পাশাপাশি নিয়মিত মক টেস্ট দেওয়া আপনাকে অন্যদের থেকে চাকরি পাওয়ার এই দৌড়ে এগিয়ে রাখবে।
- প্রতিদিন মক টেস্টে অংশগ্রহন আপনার উত্তর দেওয়ার গতিকে আরো তরান্বিত করবে পাশাপাশি কাট নাম্বারের বিপরীতে আপনি কেমন করছেন তা জানার সুযোগ থাকবে।
- ঘড়ি ধরে মক টেস্ট দিলে আপনি কোন কোন বিষয় এর মাধ্যমে শুরু করবেন সে সম্পর্কে ধারণা পাবেন।
- নিয়মিত মক টেস্ট আপনার সত্যিকারের পরীক্ষা দেওয়ার সময় হলে অনুভূত হওয়া জড়তাগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখবে। এতেকরে আপনি নির্দ্বিধায় পরীক্ষার হলে অংশগ্রহন করতে পারবেন।
- প্রতিটি মক টেস্টের পরপরই ভুল উত্তরগুলো শুধরে নিন। যা ভবিষ্যতে আপনাকে একই ধরণের ভুল করা থেকে বিরত রাখবে।
সরকারি চাকরির জন্য ইংরেজিতে ভালো করার টিপস
ইংরেজি ভাষার উপর দখল আনার অন্যতম একটি জনপ্রিয় উপায় হচ্ছে রোজ ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা পড়া। যা আপনার ভোকাবুলারি বাড়ানোর সাথে সাথে গ্রামাটিক্যাল ভুলের সম্ভাবনাও কমিয়ে দেবে। নিয়মিত ইংরেজি দৈনিক পড়ার অভ্যাস আপনাকে বাক্য গঠন, এবং গ্রামাটিক্যাল ভুল শুধরে নিতে সহায়তা করবে।
সাধারন জ্ঞানের টিপস
প্রায় প্রতিটি সরকারি চাকরির পরীক্ষাতেই সাধারণ জ্ঞান এর জন্য ভালো নম্বর বরাদ্দ থাকে। এই ক্ষেত্রে মনোমত ফলাফলের জন্য নিয়মিত কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পড়ার কোন বিকল্প নেই। যদিও এই বিশাল পরিমাণ তথ্য মনে রাখা কষ্টকর, তথাপি সাধারণ জ্ঞান পড়ার সময় মুখস্ত রাখার জন্যে কিছু ব্যক্তিগত টেকনিক ব্যবহার করা উচিত।
ভার্সিটির পর ফ্রেশার হিসেবে চাকরি খুঁজছেন? অথবা চাকরি বদলাতে চান? একটি ভালো সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য সাধারণ জ্ঞানে আশানুরূপ নম্বর পাওয়ার কোন বিকল্প নেই।
মানসিক দক্ষতায় ভালো করার টিপস
মানসিক দক্ষতা অংশে সামগ্রিক প্রস্তুতি হিসেবে সংখ্যাগত ক্ষমতা, স্থানাঙ্ক সম্পর্ক, এবং যান্ত্রিক দক্ষতা অংশের উপর জোর দিন। পরবর্তীতে মক টেস্ট দেওয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে মানসিক দক্ষতায় আপনার দখল বাড়াতে পারেন।
তবে পরীক্ষার হলে মানসিক দক্ষতা অংশের উত্তর করার সময় শুরুতেই তুলনামূলক ভাবে সহজ স্থানাঙ্ক সম্পর্ক এবং সংখ্যাগত ক্ষমতা, এই দুই ভাগের উত্তর দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে যান্ত্রিক দক্ষতা এবং ভাষাগত যৌক্তিক বিচার অংশের উত্তর দিতে পারেন।
শেষকথা
আমাদের দেশে দক্ষ এবং নিপুণ সরকারি চাকরিজীবিদের প্রয়োজন সব সময়েই ছিল এবং বর্তমানেও আছে। তবে এতে করে অন্যান্য চাকরিগুলোকে খাটো করে দেখবার সুযোগ নেই।
তবে সরকারি চাকরির প্রতি আমাদের এই অবলীলায় ছুটে চলা নিঃসন্দেহে দিন দিন একটি বিভ্রমে পরিণত হচ্ছে।ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশ তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই সরকারি চাকরির প্রস্তুতির দিকে ঝুঁকছেন, যেখানে তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকা উচিত একাডেমিক পড়াশোনার প্রতি।
তদুপরি একাডেমিক পড়াশোনা সম্পন্ন হবার পর আপনার যদি সত্যিকার অর্থেই সরকারি চাকরিজীবী হয়ে দেশকে সেবা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ হয় তাহলে আপনি সরকারি চাকরি পাওয়ার এই দৌড়ে সামিল হতে পারেন। আমরা আশাবাদী আমাদের আলোচনাকৃত পদ্ধতি বা টিপস আপনাকে কিছুটা হলেও বাকিদের থেকে এই প্রতিযোগীতাপূর্ণ অবস্থায় এগিয়ে রাখবে এবং আপনাকে চাকরির মনন ও মানসিকতায় নিজেকে তৈরি করতে সাহায্য করবে।