রমজানে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস এবং জীবনযাপনের টিপস
শুধু বাংলাদেশ নয়, চলতি বছরে পুরো বিশ্বেই রমজানের আমেজ এবং আবহ সম্পূর্ণ আলাদা। তবে এর ভালো দিকটি হচ্ছে আমাদের অধিকাংশেরই ঘরে অবস্থান করার কারণে এই রোদ এই বৃষ্টির উপদ্রব হতে শরীরকে খানিকটা নিস্তার দেওয়া যাচ্ছে, আবার পরিবারের সাথে একান্তে কিছু সময়ও কাটানো সম্ভব হচ্ছে। এছাড়াও বাইরের চটকদার কিন্তু অস্বাস্থ্যকর ইফতার সমাহারের হাতছানিও তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু বাসায় আছি বলে যা ইচ্ছে তাই খাওয়া যাবে সেটা কিন্তু নয়। পবিত্র সিয়াম সাধনার এই মাসের মূল মাহাত্ম্য হচ্ছে স্রষ্টার ইবাদত করা আর নিজ শরীরকে সুস্থ রাখাও একটা ইবাদত। তাছাড়াও বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সময় স্বাস্থ্যের বিশেষ যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই আজ আমরা মাহে রমজানে খাদ্যাভাস এবং সর্বোপরি প্রতিদিনের জীবনযাপনে কী কী মেনে চলার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ঠিক রাখা যায় তা নিয়ে আলোচনা করবো।
খাদ্যাভাসঃ
প্রচুর পরিমাণে পানীয় পান করুন
আমাদের শরীরের জন্য পানির কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে সারাদিনের রোজার পর পান করতে হবে প্রচুর পরিমাণে পানি বা পানীয় – এতে শরীর তো বটেই ত্বকের মধ্যেও ফিরে আসবে ঔজ্জ্বল্য ও সতেজতা। একটা দীর্ঘ সময় ধরে রোজা রাখার ফলে দেখা দিতে পারে পানিস্বল্পতা। তাই পুষ্টিবিদদের মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ইফতারের পর থেকে সেহেরি পর্যন্ত সময়ে পানি বা পানীয় খাওয়া উচিত কমপক্ষে ১.৫ থেকে ২ লিটার। একসাথে বেশি না পান করে অল্প অল্প পরিমাণে পান করা যেতে পারে। একটা বোতলে পানি আর একটা গ্লাস নিয়ে বসতে পারেন এতে চটজলদি মিটিয়ে নিতে পারবেন পিপাসা। অনেকেই সেহরির সময় বেশি করে পানি পান করে নেন সারাদিনের পিপাসা থেকে মুক্ত থাকার জন্য কিন্তু সেটা পেট ব্যাথা বা অস্বস্তির কারণ হতে পারে। পানির বদলে খাওয়া যেতে পারে ফলের জুস বা শরবত। তবে কোনোভাবেই পান করা যাবে না সোডা ওয়াটার বা কার্বোনেটেড বেভারেজ। এতে করে উল্টো বাড়তে পারে পানিশূন্যতা। চা-কফি গ্রহণের অভ্যাস থাকলে স্বাভাবিকের চেয়ে কম পরিমাণে পান করা যেতে পারে, তবে একেবারেই না পান করাই উত্তম।
পুষ্টিকর খাবারের ব্যাপারে গুরুত্ব দিন
রোজা রাখবো আর ভাজাপোড়া খাবো না? এরকম মনোভাব থাকলে একেবারে ঝেড়ে ফেলে দিন। কেননা রোজা এবং তৈলাক্ত খাবার – এই দুইয়ের সংমিশ্রণ হতে পারে মারাত্মক ভয়াবহ। রোজায় খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আসার কারণে হজমে সমস্যা, অ্যাসিডিটি, কোষ্ঠকাঠিন্যসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। আর অতিরিক্ত মশলাযুক্ত আর তেলে ভাজা খাবারের কারণে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই পরেরদিনের ইফতার এবং সেহরির মেন্যু কী হতে যাচ্ছে তা আগেভাগেই ঠিক করে ফেলুন। খাবারের তালিকায় সব ধরণের খাবারের সুষম বণ্টন নিশ্তিত করতে হবে। দিনভর না খেয়ে থাকার পর ইফতারে পুষ্টিকর ও হালকা ধরনের খাবার রাখতে পারেন। স্যুপ, শাকসবজি, মৌসুমি ফল ইত্যাদি সহজপাচ্য খাবার তালিকায় রাখবেন। ইফতারে ধীরে ধীরে চিবিয়ে খেলে অতিরিক্ত খাওয়া হবে না। আর মিষ্টি জাতীয় খাবারের পরিবর্তে খেজুর, বাদাম ইত্যাদি অ্যান্টিঅক্সিজেন সমৃদ্ধ খাবার দিয়ে সেই চাহিদা পূরণ করুন। অপরদিকে সারাদিন সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকার জন্য সেহরিতে ভাত, রুটি ইত্যাদি শর্করা সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে যেগুলো ধীর গতিতে হজম হয়। মাংস,ডাল, ডিম, দুধ প্রোটিনের খুব ভালো উৎস। চেষ্টা করুন এর যেকোনো একটি প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখার জন্য। রঙিন ফলমূল বা শাকসবজি সবসময়ই শরীরের জন্য উপকারী। এগুলো বেশি পরিমাণে খাবার অভ্যাস করুন।
জীবনযাপনঃ
ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। নিয়মিত প্রতিদিন গোসল করলে সুস্থ ও ঝরঝরে থাকতে পারবেন। এর পাশাপাশি দিনভর সতেজ অনুভব করবেন। এছাড়াও পরিধেয় কাপড় নিয়মিত পরিষ্কার করুন। এতে ইবাদতেও সুবিধা হবে এবং প্রশান্তি বোধ করবেন।
শারীরিক শ্রম এবং শরীরচর্চা
এখন দিনের অধিকাংশ সময়ই ঘরে কাটানোর ফলে স্বাভাবিক শারীরিক নড়াচড়া ব্যাহত হচ্ছে। তাই বলে রোজায় অলস সময় কাটালে চলবে না। অনেকেই রোজায় খুব অলস জীবন যাপন করেন। যার ফলে ওজন বেড়ে যায়। তাই একটু কর্মক্ষম থাকা উচিত। নিয়মিত নামাজ আদায় করাও একটি ভালো ব্যায়াম। অন্যান্য সময়ের চাইতেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজনীয়তা এখন অনেক বেশি। তাই ঘরবাড়ি পরিষ্কার এবং টুকটাক কাজের মাধ্যমে শরীরকে চাঙ্গা রাখতে পারেন। বেশি ভারি বা ভারোত্তলন জাতীয় ব্যায়ামের দরকার নেই কিন্তু ওজন যাতে বেড়ে না যায় তাই যতটুকু সম্ভব ফ্রি হ্যান্ড বা ফিটনেস সরঞ্জাম ব্যবহার করে হালকা শারীরিক কসরত বা ব্যায়াম করতে পারেন। অতিরিক্ত ক্যালরি ক্ষয় করার জন্য ইফতারের পর ১৫-২০ মিনিটের মতো হাঁটলে খাবারগুলোও ভালোভাবে হজম হয়। রোজায় অনেকেই সময় করে নিয়মিত শরীরচর্চা করতে পারেন না। তাঁরা শরীরের অবস্থা বুঝে ইফতারের ১ ঘণ্টা আগে, তারাবির পর কিংবা সেহরির পূর্বে- যেকোনো একটি সময় নির্ধারণ করতে পারেন। কোনোভাবেই শরীরের উপর চাপ পড়ে এমন কিছু করা যাবে না তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
ঘুম আর জীবনাচরণে আনুন পরিবর্তন
দিনে রোজা এবং রাতে বেশি সময় ধরে ইবাদত করার পাশাপাশি পর্যাপ্ত ঘুম যাতে হয় সে বিষয়েও লক্ষ্য রাখতে হবে। অনেকেই দেখা যায় সেহরি পর্যন্ত জেগে থাকেন এবং ফজরের পরেও দীর্ঘক্ষণ জেগে থাকেন। আবার অনেকে দিনের অর্ধেক ঘুমিয়েই পার করে দেন। তাঁরা এই অভ্যাস দূর করতে রাতে কাজ একটু আগেভাগেই শেষ করে শুয়ে যেতে পারেন। এছাড়াও রোজার কারণে শরীর এমনিতেই একটু দুর্বল অবস্থায় থাকে, তাই কঠিন শারীরিক পরিশ্রম হয় এমন কাজ করা উচিত নয়। ইফতারের পর বা সেহরির পর ধূমপান থেকেও বিরত থাকা উচিত।
এই রমজানে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কোথায় কিনবেন?
রমজান বা আসন্ন ঈদের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে এখন আর বাইরে যেতে হবে না। খাদ্যসামগ্রী এবং ঔষধের মতো জরুরি পণ্যগুলো ঘরে বসেই পেয়ে যাবেন এলাকার সুপার স্টোরগুলো থেকে। Bikroy এ ২৫০ রেজিস্টার্ড মেম্বারদের পোস্ট করা ৯,০০০ এরও বেশি বিজ্ঞাপনের মধ্যে রয়েছে খাবার সামগ্রী যেমন চাল, ডাল, তেল, ডিম ইত্যাদি, মাস্ক, গ্লাভস, হ্যান্ডওয়াশ, স্যানিটাইজারের মতো স্বাস্থ্যসেবার পণ্য, ঘর পরিষ্কারের জন্য গৃহস্থালি সামগ্রী, শিশুদের পণ্য যেমন দুধ এবং ফর্মুলা ডায়াপার, তাজা ফল ও সবজি, টাটকা মাছ ও মাংস ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলো।
শেষকথা
তাহলে জেনে নিলেন রমজানে সুস্থতায় কী কী করণীয়। প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় এই অভ্যাসগুলো গড়ে তুলতে পারলে শরীর ও মনের সুস্থতা যেমন বজায় থাকবে তেমনি সঠিকভাবে রোজা রাখতেও সক্ষম হবেন। আশা করছি সকলের জন্য রমজান হবে নিরাপদ এবং শান্তির।
ইবাদতের জন্য মসজিদ খুলে দেওয়া হলেও নিজেকে এবং আপনজনকে নিরাপদে রাখতে ঘরে থেকেই স্রষ্টার সাহায্য প্রার্থনা করুন। রমজান মোবারক সবাইকে!