বাংলাদেশে শিল্পকারখানায় অগ্নি নিরাপত্তা সুবিধা
কলকারখানার কাজের যে ধরণ তাতে অগ্নি নিরাপত্তার কথা উঠলে কলকারখানার অবস্থান সবসময়ই নাজুক। সেখানে প্রায়শ কোনো আবদ্ধ স্থানে বিপুল সংখ্যক কর্মী, দাহ্য বা বিস্ফোরক পদার্থ, উষ্ণ বা শুষ্ক আবহাওয়া ইত্যাদি বিরাজ করে। পৃথিবীর যে কোনো অগ্নি নিরাপত্তা বিভাগের নিকট জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন, যেকোনো স্থানে ঐরূপ অবস্থা বিরাজ করলে তা মারাত্মক অগ্নিদূর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটার পক্ষে কতটা অনুকূল হয়ে উঠতে পারে। শিল্প উৎপাদন সংশ্লিষ্ট এই ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশে অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তা বিষয়ক সমন্বয় চুক্তির আলোকে অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম উৎসের ধারণা প্রকাশিত হয়েছে, যেটি পোষাক কারখানাগুলো এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মকালীন অগ্নিনিরাপত্তার মাত্রা উন্নয়ন করার কাজে ব্যবহার করতে পারে।
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো যাতে তাদের ব্যবহারের জন্য ভাল মানের নিরাপত্তা সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে পারে সেজন্য ইতোমধ্যে কার্যকারিতা পরীক্ষিত হয়েছে এমনসব সরঞ্জাম সরবরাহকারিদেরকে নিয়ে একটি প্লাটফর্ম তৈরীর উদ্দেশ্যে সম্পাদিত এই চুক্তিতে তৈরি পোষাক কারখানাগুলোর একটি চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এই কারখানাগুলো খুচরা বিক্রেতার নিকট থেকে সম্ভ্যাব্য যেসব অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম ক্রয় করবে তা আদৌ কাজ করবে কিনা তা তারা নিজেরা গবেষণা ও পরীক্ষা করার মাধ্যমে যাচাই করার ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবে। কারণ উক্ত প্লাটফর্ম থেকে বিভিন্ন খুচরা বিক্রেতার অগ্নি নিরাপত্তা যন্ত্রপাতির কার্যকারিতা যাচাই এবং ফলাফল সরবরাহের মাধ্যমে কারখানাগুলোকে সঠিক যন্ত্রপাতি বাছাইয়ে সহায়তা করা হবে।
এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, তৈরি পোষাক কারখানাগুলোকে কর্মী এবং কর্মপরিবেশের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। এসব কারখানায় উৎপাদন প্রক্রিয়ার ধরণটিই এমন যে, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই যে সকল কর্মকালীন ঝুঁকি সৃষ্টি হয়, সে বিষয়টির সমাধান ব্যবসায় মালিকদেরকেই করতে হবে। বিশেষ করে, নিরপত্তা সরঞ্জামগুলো যদি দেশের বাইরে থেকে কেনার দরকার পড়ে, তবে সেক্ষেত্রে যা কিছু সরকারী সুযোগ সুবিধা পাওয়া সম্ভব তালিকাটিতে সে বিবরণও রয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই পূর্ব অনুমোদিত তালিকায় উল্লিখিত সরঞ্জামগুলোর ব্যবহারজনিত নিরাপত্তার ব্যাপারটি ইতোমধ্যেই বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত হয়েছে এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় নিম্নল্লিখিত বিশেষ দিকগুলো যাচাই করা হয়েছে, যেমন:
গবেষণাগার থেকে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের প্রত্যায়ন
প্রকাশ্যে ও সরাসরি চালিয়ে দেখা
নিরপত্তা প্রত্যায়ন
প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নের একটি চ্যালেঞ্জ তো রয়েছেই। বেশিরভাগ তৈরি পোষাক কারখানা এখনও পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পর্যায়েই রয়ে গেছে। কারণ এতে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা, অগ্নি সংকোচন যন্ত্রপাতি, অগ্নি নিরোধক প্রবেশ এবং নির্গমন পথ, স্বাক্ষরদান এবং আরও অনেক কিছু মিলিয়ে বেশ মোটা অংকের অর্থব্যয়ের বিষয় জড়িত। তাছাড়া, ইতোমধ্যে দেশজুড়ে চলা কলকারখানা পরিদর্শনকর্মের বিভিন্ন পরিদর্শকদলের মাধ্যমে অনেক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে জেনে গেছে যে, আসলে তাদের কী করা দরকার।
নিরপত্তা প্রচেষ্টাটি সময়োপযোগী হয়েছে। রানা প্লাজা ধ্বসের ভয়ংকর স্মৃতি আমরা এখনও ভুলতে পারিনি যেখানে ভবনটির ভেতরে ও চারপাশ জুড়ে ১,১০০-এরও বেশি কর্মী মারা গেছেন। রানা প্লাজার ঘটনার পর থেকে ভবন নিরাপত্তা এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা এই উভয়ের নিরাপত্তা পরিস্থিতির উপর জোর দেয়া হয়েছে যাতে করে পরবর্তীতে এরকম ঘটনা এড়ানো যায়। তবে শুধু তৈরি পোষাক কারখানার দিকে নজর দেয়াই যথেষ্ট নয়। গঠনকাঠামোর ত্রুটি দেখা দিলে যে কোনো ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা, যেখানে বহু লোকের উপস্থিতি প্রয়োজন হয়, তা সম্ভ্যাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়ে যায়। যারা পরিদর্শনকাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদেরকে নিজেদের কাজে গতি আনতে হবে এবং প্রাপ্তব্য প্রতিরোধক ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।
নিরাপত্তা পরিদর্শনদল কেন নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহারের তাগিদ দেয়
যেসব ভবনের আশেপাশে প্রতিনিয়ত প্রচুর লোকসমাগম হয়ে থাকে কিংবা যেসব ভবনে আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে সেসব ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও কিছু অতিরিক্ত সুবিধাদির ব্যবস্থা রাখতে হয়। অগ্নি নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা রাখা দরকার এধরনের ভবন হলো বিপনীবিতান, বিদ্যালয়, বড় বড় দপ্তরের ভবন, বহুসংখ্যক ভাড়াটিয়া বিশিষ্ট বাণিজ্যিক স্থাপনা, যন্ত্রভিত্তিক অন্যান্য উৎপাদন কারখানা, রেস্তঁরা এবং বিলাসবহুল খাবারের দোকান এবং এমনকি ছোটখাট ব্যবসার জন্য স্বল্প মেয়াদে অথবা দীর্ঘমেয়াদে ভাড়া করা স্থাপনা ইত্যাদি। বেশি ব্যস্ত ভবনগুলো অর্থাৎ একই ভবনের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কাজ চলে এবং যেখানে ভিন্ন ভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে আবিশ্যকভাবে কোনো সমন্বয় থাকে না এমন ভবনগুলো বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ।
কোনো ভবনের নিরাপত্তা উন্নয়নের বিষয়টি ভবনটিতে প্রাপ্তব্য দৃশ্যমান সুবিধাবলীর পরিমাণ থেকেই বোঝা যায়। একারণেই নিয়মিতভাবে ভবন নিরাপত্তা পরিদর্শন করা এতো গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞগণ প্রথমত ভবনটির ধরণ সম্পর্কে নিশ্চিত হন। একজন সাধারণ মানুষের কাছে কংক্রীট এবং স্টিলের তৈরি ভবনকে অগ্নিদূর্ঘটনার ব্যাপারে কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটিতে এমন অনেক উপাদান থাকতে পারে যা সম্ভ্যাব্য অগ্নিদূর্ঘটনার ক্ষেত্রে অগ্নিপ্রজ্জ্বলন ক্ষমতা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাপমাত্রা যখন যথেষ্ট উচ্চ হয়ে ওঠে কংক্রীটে তখন ফাটল সৃষ্টি হয় এবং কংক্রীট ঝুরঝুরে হয়ে দ্রুতই আলগা হয়ে যেতে পারে। তাতে করে ভবন ধ্বসে যেতে পারে। কাঠের অবকাঠামোসহ ইঁটের তৈরি দালানের ক্ষেত্রে দেয়ালগুলো বড় বড় খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে এবং দেয়ালের কিছু অংশের ভার বহনকারী চৌকাঠগুলো সহজেই ভেঙ্গে যেতে পারে। ভারীকাঠের তৈরি ভবনগুলো প্রায়শই দেয়াল গেঁথে এবং কাঠের অবকাঠামো দিয়ে তৈরি করা হয়। ভারী কাঠ হয়ত পুড়তে অনেক সময় নিবে কিন্তু ইঁট-সিমেন্টের গাঁথুনিযুক্ত দেয়ালে ফাটল দেখা দেবে এবং তা টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। সুতরাং ভবনের ধরণ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা বিশেষ জরুরী।
তারপর অন্য একটি পরিদর্শনের মাধ্যমে ভবনের ধারণক্ষমতা, পরিসর এবং মালামাল পরিবহণ পদ্ধতি যাচাই করা হবে, এবং পাশাপাশি দেখা হবে ভবনের কোন কোন স্থানে একই দরজা দিয়ে প্রবেশ ও বহির্গমনের ব্যবস্থা রয়েছে। আতংকগ্রস্ত অবস্থায়, যেনতেনভাবে নির্মিত একটি বহির্গমন পথ প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। তাই ঝুঁকি প্রতিরোধের জন্য একটি অনুমোদিত এবং প্রশস্ত বহির্গমন পথ থাকাটা জরুরি। আবার, কিছু কিছু ভবনের অভ্যন্তরীণ সিলিংয়ের উপর অপ্রয়োজনীয় ফাঁকা স্থান রেখে দেয়া হয়। এসব ফাঁকা স্থানে কার্বন মনোক্সাইড জমতে থাকবে, যা দহনশীল পদার্থ হতে উৎপন্ন একটি গন্ধহীন অদৃশ্য কিন্তু প্রাণঘাতী গ্যাস। ভবনের কোথাও এভাবে ধীরে ধীরে কার্বন মনোক্সাইড আটকা পড়ে থাকলে তা যে শুধু ভবনের ভেতরে শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণকারী লোকজনের জন্য মারাত্মক হতে পারে তা ই নয়, বরং এটি দাহ্য হওয়ার কারণে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় তা হঠাৎ জ্বলে উঠে বিস্ফোরিত হতে পারে। যদি হঠাৎ ঝলকানির মত বিস্ফোরণ ঘটে তবে ভবনের ভেতরে থাকা লোজনের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকবে, কারণ তপ্ত গ্যাসের সাথে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা যুক্ত হলে তা তখন ১,০০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠে যেতে পারে।
উপর্যুক্ত তথ্যাবলীর সাহায্যেই নির্দিষ্ট কোনো ভবনের অগ্নি নিরাপত্তার জন্য সঠিক নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি বেছে নেয়া যাবে। পানি ছিটানোর যন্ত্র থেকে শুরু করে অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র পর্যন্ত এবং এ দুয়ের মধ্যবর্তী সমস্ত সরঞ্জামের বেলাতেই একথা খাটে। উঁচু কোনো ভবনের প্রতি তলায় পানির ট্যাংকের সাথে সরাসরি সংযুক্ত মোটা ব্যাসের পাইপের মুখ বা স্ট্যান্ডপাইপ তৈরি রাখলে তা অগ্নি দূর্ঘটনার সময় পানির দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করবে। এতে করে অগ্নিনির্বাপন কর্মীরা স্ট্যান্ডপাইপের সাথে শুধুমাত্র একটি হোসপাইপের সংযোগ দিয়ে এবং চাবি ঘুরিয়ে যে কোনো তলায় পানির প্রবাহ পেয়ে যাবে। অভ্যন্তরীণ হোস দেয়ালের সাথে ঝুলিয়ে দেয়া যেতে পারে, যাতে করে প্রশিক্ষিত কোনো কারখানাকর্মী আগুন বড় আর বিপদজনক হয়ে ওঠার আগেই পানি ছিটানোর কাজে তা ব্যবহার করতে পারে। স্মোক ডিটেকটর এবং কার্বন মনোক্সাইড ডিটেকটর রাখতে হবে যাতে করে তা সংশ্লিষ্ট অদৃশ্য ঝুঁকিটি প্রাণঘাতী হয়ে ওঠার আগেই লোকজনকে সতর্ক করতে পারে। সমন্বয় চুক্তির অধীনে কৃত নিরাপত্তা সরঞ্জাম খুচরা বিক্রেতাদের চূড়ান্ত তালিকায় নির্দিষ্ট কোনো নিরাপত্তা সুবিধার বিপরীতে পরিদর্শকের সুপারিশসহ যাবতীয় বিষয় অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।
সার সংক্ষেপ
বাণিজ্যিক ও শিল্পকারখানা সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলোর অগ্নিদূর্ঘটনা ঝুঁকি প্রতিরোধ করা সম্ভব। অনেক দূর্ঘটনার প্রাথমিক কারণ আপনি আপনিই ঘটে না বরং তা মানবসৃষ্ট হয়ে থাকে। নির্দিষ্ট সুবিধার লক্ষ্যে বোধগম্য ঝুঁকি প্রতিরোধ পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অগ্নিদূর্ঘটনার ক্ষতি থেকে তার কর্মীবাহিনী, তার যন্ত্রপাতি এবং তার বিনিয়োগের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। সর্বসাকুল্যে এটিই হলো ঝুঁকির সকল দিকের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং এ ধরনের ঝুঁকি পরিকল্পিত উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।