সেলস চাকরিঃ যেভাবে হতে পারেন একজন পেশাদার বিক্রয়কর্মী
বেশ প্রচলিত একটা প্রশ্নের মাধ্যমেই শুরু করা যাক। আপনি কি জানেন, একটা ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য সেলস টিমের উপর কি কি দায়িত্ব থাকে? সেলস টিমের কাজগুলোকে বেশ কিছু ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কিছু যেমন পণ্য ডিজাইন করা, ব্যবসার সুবিধার্থে জনতাত্ত্বিক জরিপ চালনা করা, বাজার বিশ্লেষণ করা, বিজ্ঞাপন প্রচারসহ নানাবিধ কাজে সেলস কর্মীদের বিচরণ।
দেশের বাজারে অনেক প্রতিষ্ঠান সেলস এবং মার্কেটিং টিমকে আলাদা দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে পরিচালিত করছে, যাতে করে কর্মীদের কাজের চাপ কমার পাশাপাশি, এই বিভাগে অনেক জনবল নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। অন্যথায় ছোট এবং মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো এই দুটো বিভাগকে একত্রিত করার মাধ্যমে তাদের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।
দক্ষকর্মী ছাড়া আশানুরূপ ফল পাওয়া অসম্ভব, আর তাই প্রতিষ্ঠানগুলোও চাইছে এমন সব বিক্রয়কর্মী যারা তাদের গ্রাহকদের চাহিদানুযায়ী সেবা প্রদানে সক্ষম। তাই নিজেকে একজন পেশাদার বিক্রয়কর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে নিজেকে সঠিক উপায়ে প্রস্তুত করার পাশাপাশি বাংলাদেশে সেলস-এর চাকরির বিজ্ঞপ্তিগুলোতে চোখ রাখতে হবে নিয়মিত।
সেলসে ক্যারিয়ার করার সুযোগ-সুবিধা
নতুনদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা সেলসের চাকরিতে আবেদন করার সময় দ্বিধায় ভোগেন। তাদের চোখের সামনে ভাসে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা বিক্রয়কর্মীদের কথা, যা বেশ পরিশ্রমসাধ্য।
তবে বর্তমানে এই ধরণের চিন্তা-চেতনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সেলসে ক্যারিয়ার আপনাকে এমন কিছু সুবিধা এনে দিবে যা অন্য কোনো পেশা থেকে আপনি আশা করতে পারেন না। যার মধ্যে অন্যতম কিছু হলোঃ
- নিয়মিত কাজ শেখার সুযোগঃ সেলসে ভালো করার মাধ্যমে আপনি প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শেখার সুযোগ পাবেন। নিত্যনতুন গ্রাহক, তাদের সমস্যা, এবং সেই সমস্যার সমাধান আপনাকে গড়ে তুলবে একজন দক্ষ বিক্রয়কর্মী হিসেবে। হয়ত কাজ করার সময় আপনি অনুভব করতে পারেন বেশকিছু বাধা বিপত্তি- ধৈর্য্যের অভাব, সামাজিক দক্ষতার অভাব, সাহসের অভাব, অনেকের সামনে কথা বলার মত সাহসের অভাবসহ নানান সমস্যা; তবে সমস্যা যাই হোক না কেন, আপনাকে এসব বিপত্তি ঠেলে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। পেশাদার হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলার যার কোনো বিকল্প নেই।
- প্রতিটি দিনই হয়ে উঠবে উৎপাদনশীলঃ সেলসে চাকরি আপনাকে কখনো একঘেয়েমি অনুভব করাবে না। প্রতিটি ক্লাইন্টের বা গ্রাহকের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা হবে আলাদা এবং চ্যালেঞ্জিং। সেলস কর্মী মানে এই নয় যে, কিছু লাইন মুখস্ত করে সব গ্রাহকের কাছে তা আওড়ানো, বরং গ্রাহকের চাহিদা এবং বাজেট অনুযায়ী সেবা নিশ্চিত করাই একজন দক্ষ সেলস কর্মীর কাজ।
- পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগঃ প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানের জন্যেই সেলস একটি অত্যাবশ্যক অংশ তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই চায় এই খাতে দক্ষ জনবল নিয়োগ করতে। সুতরাং একজন বিক্রয়কর্মী হিসবে আপনার যেকোনো প্রতিষ্ঠান, পে-স্কেল, বা পদে চাকরির সুযোগ রয়েছে।
- পরিবর্তনযোগ্য দক্ষতাঃ প্রায় প্রতিটি পেশাতেই সেলস-এর দক্ষতাগুলো ব্যবহারযোগ্য। হয়ত আপনি আপনার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একজন বিক্রয়কর্মী হিসেবে কিন্তু এখন অন্য পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চাইছেন, এসময়ে আপনার সেলস এর দক্ষতাগুলো আপনার নতুন পেশাকে ভালোভাবে রপ্ত করতে সাহায্য করবে।
যখন আপনি গ্রাহকদের সমস্যা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন কিংবা যখন আপনার কথা গ্রাহকেরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনবে ঠিক তখনই দুই পক্ষের মধ্যে একটি শক্ত ব্যবসায়িক বন্ধন তৈরি হওয়া সম্ভব। সেলস এর সাথে কাজ করার মাধ্যমে পাওয়া এই দক্ষতা আপনাকে যেকোনো পেশায় নিয়ে যাবে এক অনন্য উচ্চতায়।
বাংলাদেশে সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে যেসব যোগ্যতা আবশ্যক
ব্যবসায়িক বিষয়সমূহে স্নাতকোত্তর আছে এমন প্রার্থীরা সেলসে চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেতে পারেন। বর্তমানে বাংলাদেশে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এমবিএ ডিগ্রীধারী প্রার্থীদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা থাকে। তাই আপনার স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর যদি ব্যবসায়িক কোনো বিষয়ের উপর হয়ে থাকে, তাহলে আপনার অন্যান্যদের চেয়ে দ্রুত ইন্টারভিউ কল পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
সেলসে চাকরি পাওয়ার জন্য মূলত যেসব যোগ্যতার প্রয়োজনঃ
- যেসব প্রার্থীদের অনার্স বা স্নাতক পর্যায়ে বিবিএ ডিগ্রী আছে।
- যেসব প্রার্থীদের মার্কেটিং বা বিপণন এর উপর এমবিএ ডিগ্রী সহ সেলসের উপরে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে।
- যেসব প্রার্থীদের ভিন্ন বিষয়ের উপর অনার্স অথবা স্নাতক হলেও সেলস এবং মার্কেটিং এর উপরে কাজ করার দক্ষতা আছে।
সেলসে চাকরির ধরণ
সেলস সম্পর্কিত প্রতিটি চাকরিরই রয়েছে ভিন্ন কাজের ধরণ, পদ এবং বেতন কাঠামো। পাশাপাশি কাজ অনুযায়ী কমিশনসহ ব্যক্তিগত উন্নয়নের সুযোগতো থাকছেই।
তবে আবেদন করার পূর্বে আপনার দায়িত্ব কী হবে এবং ভবিষ্যতে কী কী সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে সেগুলো ভালোভাবে জেনে নিতে হবে।
একজন সেলস কর্মী হিসেবে যে ধরণের পদে নিয়োগ পেতে পারেনঃ
- মার্কেটিং ম্যানেজারঃ একজন মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে আপনার উপরে বেশ কিছু দায়িত্ব আরোপিত হতে পারে যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হল পণ্য/সেবা অথবা ব্র্যান্ডের প্রচার এবং আপনার প্রতিষ্ঠানের বিপণন সম্পর্কিত সব কাজ দেখভাল করা। একই রকম কাজ আপনি সেলস ও মার্কেটিং এজেন্সিগুলোতেও পেতে পারেন।
- পাবলিক রিলেশন ম্যানেজারঃ পাবলিক রিলেশন ম্যানেজার হিসেবে আপনাকে কিছু ক্যাম্পেইন পরিচালনা করতে হবে যা মূলত আপনার প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়া, অন্য প্রতিষ্ঠান, ব্যাক্তিদের মধ্যে সকল প্রকার ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সাহায্য করবে।
- পাবলিক রিলেশন স্পেশালিস্টঃ এই পদের কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আপনার প্রতিষ্ঠান/ব্র্যান্ড কে জনসাধারণের চোখে সুপরিচিত করা যা সাধারণত প্রেস রিলিজ এবং বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমেই সচরাচর করা হয়ে থাকে ।
- কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজারঃ কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার হিসেবে আপনাকে গ্রাহকদের বিভিন্ন চাহিদার উপর ভিত্তি করে নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য পরিকল্পনা সাজানো এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে সুষ্ঠ যোগাযোগ দক্ষতা থাকা অপরিহার্য।
সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে যে সমস্ত জায়গায় কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে
প্রায় প্রতিটি ইন্ডাস্ট্রিতেই রয়েছে তাদের নিজস্ব সেলস ডিপার্টমেন্ট। সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে যেসব খাতে পাওয়া যেতে পারে কর্মসংস্থানের সুযোগঃ
- মার্কেট রিসার্চ
- বিজ্ঞাপন সংস্থা
- আইটি ফার্ম
- অনলাইন মার্কেটপ্লেস
- ই-কমার্স
- রিটেইল
- মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ
- আর্থিক ও ইন্স্যুরেন্স সংস্থা
- সরকারি প্রযুক্তি সংস্থা
- কনসাল্টিং ফার্ম
বাংলাদেশে সেলস চাকরির পে স্কেল
আমাদের দেশে আকর্ষণীয় বেতনের যেসমস্ত জনপ্রিয় চাকরি রয়েছে তাদের মধ্যে সেলস চাকরি অন্যতম, যেখানে আপনার একজন সাধারণ বিক্রয়কর্মী থেকে একজন পেশাদার সেলস এক্সিকিউটিভ হয়ে উঠার সুযোগ রয়েছে। তবে অনেকেই সেলসে ক্যারিয়ার শুরু করেন সেলস রিপ্রেজেন্টিটিভ হিসেবে।
আমাদের দেশে একজন সেলস রিপ্রেজেন্টিটিভের বার্ষিক বেতন হয়ে থাকে প্রায় ২,৪০,০০০ টাকা থেকে ৩,৫০,০০০ টাকা। দুই অথবা তিন বছরের অভিজ্ঞতা অর্জনের পরে পদোন্নতি পেয়ে হতে পারেন একজন জুনিয়র সেলস ম্যানেজার। সেসময়ে আপনার বেতন হতে পারে বার্ষিক ৫,০০,০০০ টাকা থেকে ৭,০০,০০০ টাকা। পরবর্তীতে ১০-১৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পেশাদার সেলস ম্যানেজারদের বার্ষিক বেতন হয়ে থাকে সচরাচর ১৫,০০,০০০ টাকার উপরে।
চলুন দেখে নেওয়া যাক বাংলাদেশে ইন্ডাস্ট্রিভেদে একজন অভিজ্ঞ সেলস ম্যানেজারের বেতন কেমন হতে পারেঃ
ইন্ডাস্ট্রি | সেলস ম্যানেজারের বার্ষিক বেতন (টাকায়) |
উৎপাদনকারী | প্রায় ১৫,০০,০০০ টাকা |
আর্থিক প্রতিষ্ঠান | প্রায় ১০,০০,০০০ টাকা |
রিটেইল | প্রায় ১২,০০,০০০ টাকা |
পাইকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান | প্রায় ১৫,০০,০০০ টাকা |
শেষকথা
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতই বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে একটি খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে দেশের শিল্পগুলো তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে এসেছে বেশ বড় কিছু পরিবর্তন।
সেলসে চাকরি পেতে হলে আগামীর অপেক্ষায় না থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি দক্ষতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। কারণ সময়ের সঠিক ব্যবহার এবং ক্রমাগত নিজের দক্ষতা বাড়িয়ে নেওয়াই আপনাকে সেলসে একটি আকর্ষণীয় ক্যারিয়ার গড়ার পথে সহায়তা করতে পারে।
“নিউ নরমাল” আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে প্রযুক্তি এবং স্মার্ট-ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে বিশ্ব দ্রুত এগিয়ে চলেছে। সুতরাং সেলসসহ অন্যান্য যেকোনো পেশায় নিজের ক্যারিয়ার গড়তে হলে পত্রিকার পাশাপাশি দেশের অনলাইন জব পোর্টালগুলোতে নিয়মিত চোখ রাখার বিকল্প নেই।
আগামীর জন্য নিরন্তর শুভকামনা!