দেশের বাজারে মার্কেটিং-এ চাকরির আদ্যোপান্ত
বর্তমানে দেশের বাজারে মার্কেটিং-এ চাকরির চাহিদা প্রতিনিয়ত হুহু করে বেড়েই চলেছে। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে মানুষের চাহিদা এবং প্রচারের ধরণ দুই-ই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং কেন্দ্রিক নিয়োগের এক তথ্যানুযায়ী প্রায় ৮৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই তাদের জন্য কর্মনিষ্ঠ এবং মেধাবী মার্কেটার নিয়োগ দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে।
তদুপরি ২০২১ সালে চাকুরির বাজারে মার্কেটিং বিভাগের জন্য যে দক্ষতাগুলোর চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ব্র্যান্ডিং, সেলস, বিজ্ঞাপন, এবং অনলাইন মার্কেটিং-এর মত সৃজনশীল কিছু ক্ষেত্র।
অনেক প্রতিষ্ঠানই হয়তো সেরা দামে সেরা পণ্যটি সরবরাহ করতে পারে কিন্তু পণ্যের বিজ্ঞাপনই যদি গ্রাহকের কাছে না পৌঁছায় তাহলে তা কিভাবে সম্ভব? ঠিক এই জায়গাতেই মার্কেটিং বা বিপণন মূখ্য ভূমিকা রাখে।
যেকোন ধরণের ব্যবসার জন্যেই মার্কেটিং প্রয়োজনীয় একটি অংশ। সর্বোপরি আমরা আজকের আয়োজনে মার্কেটিং ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য এবং বাংলাদেশে মার্কেটিং-এ চাকরি নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
বাংলাদেশে মার্কেটিং-এ চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় কিছু দক্ষতা
ব্যাচেলর সম্পন্ন করার পর মার্কেটিং এর দুনিয়া যদি আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে তাহলে বেশ কিছু দক্ষতা শুরু থেকেই অর্জন করে নেওয়া ভালো। দেখে নিন কি কি দক্ষতা আপনার মার্কেটিং ক্যারিয়ারকে আরো সফল করে তুলতে সাহায্য করবে-
- যোগাযোগ দক্ষতাঃ মার্কেটিং করার অন্যতম একটি প্রধান মাধ্যম হল যোগাযোগ। কারণ এই পেশায় আপনাকে প্রতিনিয়ত আপনার গ্রাহকের সাথে আপনাকে লিখিত বা মৌখিকভাবে যোগাযোগ করতে হবে। এছাড়াও এই ক্যাটাগরির মধ্যে রয়েছে কন্টেন্ট রাইটিং, মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট তৈরি করার দক্ষতা ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসায়িক ক্যাম্পেইন চালানোর সক্ষমতা।
- সৃজনশীলতাঃ একজন মার্কেটার হিসেবে আপনাকে অবশ্যই সৃজনশীল বিভিন্ন চিন্তাভাবনা এবং আইডিয়া তৈরি করতে জানতে হবে যাতে করে সহজেই গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো এবং আপনার ব্র্যান্ড-কে প্রমোট করতে পারেন।
- বিশ্লেষণী দক্ষতাঃ অ্যানালাইটিকাল বা বিশ্লেষণ করার দক্ষতার মধ্যে রয়েছে বাজার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা রাখা, বর্তমান ট্রেন্ড, এবং গ্রাহকের চাহিদা বুঝতে পারার ক্ষমতা।
- প্রযুক্তিগত দক্ষতাঃ প্রয়োজনীয় কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ক্যাম্পেইন রান করা অব্দি কম্পিউটার কেন্দ্রিক বিভিন্ন দক্ষতা আপনাকে এনে দেবে বাড়তি কিছু সুবিধা। এছাড়াও উক্ত ক্যাটাগরির অন্যান্য যেসমস্ত দক্ষতা থাকা প্রয়োজনীয় তার মধ্যে রয়েছে- এসইও, মাইক্রোসফট অফিস, পিপিসি, কপিরাইটিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ইত্যাদি।
- নেগোসিয়েশন দক্ষতাঃ কিভাবে নিজের প্রস্তাব বা বাজেট কে গ্রাহকের কাছে সঠিক উপায়ে উপস্থাপন এবং যৌক্তিক করে তুলতে হয় তার ধারণা থাকাই মূলত নেগোসিয়েশন দক্ষতা। তাই মার্কেটিং-এ সাফল্য লাভের পন্থা হিসবে একজন পেশাদার মার্কেটার হওয়ার পাশাপাশি চেষ্টা করতে হবে একজন সফল নেগোশিয়েটর হিসেবেও নিজেকে গড়ে তোলার।
মার্কেটিং-এ চাকরি পেতে যেমন শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন
একটি ভালো মার্কেটিং জব পাওয়ার অন্যতম প্রধান মাপকাঠি হল আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা। ঢাকায় মার্কেটিং চাকরি সহ বাংলাদেশের যেকোন স্থানে এই ক্ষেত্রে চাকরি পেতে হলে যে ধরণের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রয়োজনঃ
- মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় ব্যবসায় শিক্ষা (কমার্স) বিভাগ বেছে নিতে পারেনঃ বাংলাদেশে মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের সময় বিজ্ঞান, আর্টস (কলা), এবং ব্যবসায় শিক্ষা; এই তিন বিভাগের যেকোন একটি বেছে নিতে হয়। আপনি পরবর্তী সময়ে মার্কেটার হিসেবে ক্যারিয়ার দাড় করাতে চাইলে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে আপনার মাধ্যমিক এবং উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে পারেন। এতে করে এই পরিসরে আপনার একটি ভালো ভিত্তি তৈরি হবে।
- স্নাতক পর্যায়ে নিতে পারেন বিবিএ/বি.কম ডিগ্রীঃ মার্কেটারদের নিয়োগের সময় মূলত তাদের নিজস্ব কাজের ধরণের উপর ভিত্তি করে অনার্স ডিগ্রী চাওয়া হয়ে থাকে। বিবিএ এবং বি.কম এই দুটো ডিগ্রীই আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ৪ বছর মেয়াদী কোর্স হিসবে পড়ানো হয় এবং সিলেবাসের বিষয়গুলোতেও থাকে বেশ কিছু মিল।
দুটো ডিগ্রীর কোন একটি নেওয়ার সময়ে আপনি যেই বিষয়গুলো সম্পর্কে জানবেন তার মধ্যে রয়েছেঃ মার্কেটিং, মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ দক্ষতা, হিসাব বিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক আইন সহ আরও অনেক বিষয়।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক স্তরের ভর্তি পরীক্ষা মূলত লিখিত ও মৌখিক আকারে হয়ে থাকে এবং উত্তীর্ণ প্রার্থীরা চার বছর মেয়াদী ডিগ্রী গ্রহনের সুযোগ পান।
- স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এমবি ডিগ্রী আপনাকে দেবে বাড়তি মূল্যায়নঃ এক্সিকিউটিভ পর্যায়ের চাকরি পেতে হলে সচরাচর এমবিএ ডিগ্রী চাওয়া হয়। মার্কেটিং এর প্রতি ঝোঁক থাকলে একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি সার্টিফিকেশন কিছু কোর্স করে ফেলতে পারেন।
বর্তমানে দেশে বিভিন্ন প্রাইভেট এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রেগুলার এমবিএ -এর পাশাপাশি সান্ধ্যকালীন এমবিএ করার ও সুযোগ রয়েছে।
অনলাইন মার্কেটিং সার্টিফিকেশন কোর্স
স্নাতক সম্পন্ন হবার পর চাকরিতে প্রবেশের আগে করে নিতে পারেন কিছু সার্টিফিকেশন কোর্স। এতে করে পরবর্তী সময়ে মার্কেটিং সম্পর্কিত কিছু কাজ আপনার জন্য সহজ হয়ে উঠবে। মার্কেটিং সহ বাংলাদেশের অন্যান্য জনপ্রিয় চাকরিগুলো পাওয়ার ক্ষেত্রে যেসমস্ত কোর্স আপনাকে সাহায্য করতে পারে তার কয়েকটি তুলে ধরা হলোঃ
- গুগল অ্যানালাইটিক্স সার্টিফিকেশন
- গুগল এডওয়ার্ডস সার্টিফিকেশন
- মজ একাডেমী সার্টিফিকেশন
- ফেইসবুক ব্লুপ্রিন্ট সার্টিফিকেশন
- হাবস্পট মার্কেটিং একাডেমী
- হটসুইট স্যোশাল মিডিয়া কোর্স
- আমেরিকান মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশন এর পেশাদার মার্কেটিং কোর্স
বাংলাদেশে মার্কেটিং-এ চাকরির যত সুযোগ
মার্কেটিং একটি বৃহৎ ক্ষেত্র, যার বিভিন্ন পদ এবং কাজের ধরণ আপনি চাকরির বিজ্ঞাপনগুলোর মাধ্যমে জেনে থাকবেন। তবে দেশের বাজারে মার্কেটিং এর যেসকল জনপ্রিয় চাকরি রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলোঃ
ডিজিটাল মার্কেটিং
বর্তমানে সমস্ত পৃথিবী ব্যাপী পণ্য প্রচারণার একটি বড় অংশ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। তাই বলা যেতে পারে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল মার্কেটিং চাকরি একটি সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার। ডিজিটাল মার্কেটিং এর মধ্যে জনপ্রিয় যেসব চাকরির ক্ষেত্র রয়েছেঃ ব্র্যান্ডিং, স্যোশাল মিডিয়া মার্কেটিং, এসইও, কন্টেন্ট মার্কেটিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ইত্যাদি।
ডিরেক্ট মার্কেটিং
ডিরেক্ট বা ট্র্যাডিশনাল মার্কেটিং-এ আপনাকে ইমেইল, ফোন নাম্বার, অথবা কেনাকাটার তথ্য অনুযায়ী গ্রাহকের কাছে পৌছাতে হবে এবং তাদেরকে পণ্য বা সেবা সম্পর্কে অবগত করাই মূলত ডিরেক্ট মার্কেটিং-এর কাজ। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের ক্লাইন্টদের কোল্ড ইমেইল করার মাধ্যমেও তাদের নতুন বা আসন্ন প্রোডাক্ট এর ব্যাপারে জানিয়ে থাকেন।
মার্কেট রিসার্চ
যারা ডিজিটাল মার্কেটিং এর জগতে মার্কেট রিসার্চ বা গবেষণার কাজে নিয়োজিত থাকেন তারা মূলত গ্রাহকদের চাহিদার উপর ভিত্তি করে মার্কেটের বর্তমান ট্রেন্ডগুলো সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানকে অবগত রাখেন। তবে মার্কেট রিসার্চ শুধু মাত্র নাম্বার এবং পরিসংখ্যান এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর সাথে জড়িয়ে থাকে গ্রাহকের মনস্তত্ব অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত বিষয়গুলোও।
পাবলিক রিলেশন
পাবলিক রিলেশনের মধ্যমে মূলত গ্রাহকের সাথে প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কের উপর জোর দেওয়া হয়ে থাকে। এই পদে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে আপনি কোম্পানির একজন মুখপাত্র হিসেবে কাজ করবেন পাশাপাশি অন্যান্য ব্র্যান্ডদের কাছে নিজেদের সুষ্ঠু সম্পর্ক বজায় রাখার দায়ভারও আপনার উপর থাকবে। এছাড়াও পাবলিক রিলেশনের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে নিজেদের প্রমোশন করতে হয়।
বিজ্ঞাপন
মার্কেটিং-এর মধ্যে বিজ্ঞাপন একটি জনপ্রিয় টার্ম যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া (টিভি/রেডিও), প্রিন্ট মিডিয়া, স্যোশাল মিডিয়া, ডিরেক্ট ইমেইল এবং অন্যান্য কিছু প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের ব্র্যান্ডকে মানুষের কাছে সুপরিচিত করা। প্ল্যাটফর্ম অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দ করলে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভালো সাড়া পাওয়া সম্ভব।
ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্ট
বিজ্ঞাপনের মত ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্টের মধ্যেও রয়েছে নানাবিধ কাজের সুযোগ বা ক্ষেত্র। যেমনঃ ব্র্যান্ড পজিশনিং, গ্রাহক সেবা, এবং কম্পিটিটরদের ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য। যেহেতু মার্কেটিং এর মূল কনসেপ্ট হলো প্রচারের মাধ্যমে পণ্যের বিক্রি বাড়ানো, তাই গ্রাহকের কাছে ব্র্যান্ডিং করার মাধ্যম হিসেবে পাবলিক রিলেশন, ফোন ডিরেক্টরি, অনলাইন মিডিয়া, ইমেইল সহ নানা প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়।
শেষকথা
আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি কমার্সিয়াল সেক্টরেই রয়েছে মার্কেটারদের বিচরণ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলোঃ ব্যাংক, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান, মার্কেটপ্লেস, স্টার্টআপ, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কৃষি-ভিত্তিক সংস্থা সহ নানাবিধ প্রতিষ্ঠান এবং শিল্প।
মার্কেটিং এর এই বিশাল পরিসরে পদচারণার জন্য মূলত আপনাকে হাতের মুঠোয় রাখতে হবে নিত্য নতুন মার্কেটিং ট্রেন্ড, দেশের বাজারে মার্কেটিং-এ চাকরির বিজ্ঞাপনের ওয়েবসাইট, এবং আপনার দক্ষতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা।
আমরা আশাবাদী আমাদের আজকের লেখার মাধ্যমে আপনি বাংলাদেশে মার্কেটিং-এ চাকরির ব্যাপারে সকল তথ্য সম্পর্কে অবগত হবেন এবং খুঁজে পাবেন আপনার কাঙ্ক্ষিত চাকরিটি!